স্বপ্ন ও সাধ্যের ফারাক

আমি ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর শিক্ষকতা করেছি। এর মধ্যে ১২ বছরই কেটেছে ঢাকার নটর ডেম কলেজে। এই দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াও শিক্ষা–বিষয়ক লেখালেখি ও আনুষঙ্গিক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম। আজ অতীতের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন নটর ডেম কলেজে পড়াই। হঠাৎ করে একদিন মনে একটি ভাবনার উদয় হলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা নিজ নিজ ছাত্রছাত্রীদের সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি দিতে পারেন না কেন? দৈনিক পত্রিকায় একটি লেখা পাঠালাম। ছাপা হলো, কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত অধ্যাপক, শিক্ষক-আন্দোলনের নেতাদের জিজ্ঞেস করি, কোনো সদুত্তর পাই না। বুঝতে পারি আমাদের মতো শিক্ষকদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁরা সন্দিহান, মন খোলাসা করতে চান না।

কিন্তু তাঁদের সন্দেহ ছিল অমূলক। আমার শিক্ষকদের কথা বাদই দিলাম, আমার সহকর্মী ও সমকালীন শিক্ষকেরাও ছিলেন নীতিনিষ্ঠ ও দক্ষ, ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত। ১৯৭৪ সালে রাশিয়ায় গিয়ে দেখেছি সেখানকার স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরাই কাজটা করেন কোনো পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াই। আমাদের ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র কোনো দিন শিক্ষকদের ক্ষমতায়িত করতে চায়নি, তাঁদের চিরকাল দরিদ্র ও দুর্বল করে রেখেছে। অন্যথা ঘটলে আজকের পরিস্থিতি হয়তো অন্য রকম হতো। আমার ওই ভাবনার কথা এখন মনে পড়লে বড়ই অসহায় বোধ করি।

বাংলাদেশ পুঁজিতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে; পুরোনো সমাজকাঠামো ভেঙে পড়ছে এবং সেই সঙ্গে সাবেকি নীতিনৈতিকতাও। পুঁজি সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরিত করে এবং শিক্ষাও কোনো ব্যতিক্রম নয়। অতঃপর চিরকালের বঞ্চিত দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষকেরা যদি বিদ্যার দোকান খুলে বসেন, তাতে তাঁদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় কি? লুটেরাদের এই রাজত্বে তাঁরা একইভাবে নৈতিকতার ধারক ও বাহক হয়ে থাকবেন—এমন দাবি যৌক্তিক নয়। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রটি সুবিশাল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা যথাক্রমে ২ কোটি, ৮০ লাখ ও ২০ লাখ। পুঁজির কাছে ক্ষেত্রটি বিনিয়োগের জন্য লোভনীয়, তাই শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটবে ও ঘটছে।

পুঁজিতন্ত্রেরও অবশ্য নিয়মকানুন ও নীতিনৈতিকতা আছে, যা প্রাথমিক সঞ্চয়পর্বে ততটা মান্য করা হয় না। এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংকট, যা দক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বে উত্তরণ সম্ভব। এটা কোনো অত্যাশা নয় যে আমরাও একদিন সুখী ও সমৃদ্ধ একটি সমাজের বাসিন্দা হতে পারব। পরিবেশ রক্ষা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সরকারের অনমনীয় অবস্থান।

সব রাস্তা যেমন রোম নগরে পৌঁছায়, তেমনি আমাদের সব সমস্যাও শেষাবধি পুঁজিতন্ত্রে গিয়ে ঠেকে। প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ের এ যুগ অবাধ লুণ্ঠনের যুগ আর তাতে যথেচ্ছ লুণ্ঠিত হয় শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পদভান্ডারও। এখানে প্রেম প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। শ্রমজীবীকে ‘ভাই’ এবং প্রকৃতিকে ‘মা’ বলা অর্থহীন আওয়াজ মাত্র। শোষণ ছাড়া পুঁজি সৃষ্টি হয় না আর পুঁজি ব্যতীত কোনো বৃহৎ নির্মাণও সম্ভব নয়। পুঁজি হলো উন্নয়নের চালিকাশক্তি। ‘অপুঁজিবাদী উন্নয়ন’ বলে কিছু নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্নয়নশীল দেশে এই তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্য অঢেল অর্থ ও শক্তি ক্ষয় করে ব্যর্থ হয়েছে।

এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে পুঁজিতন্ত্র দ্বন্দ্বকীর্ণ মানবস্বভাবের সঙ্গে সবচেয়ে লাগসই ও সর্বোত্তম সমাজব্যবস্থা। আমি পুঁজিতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গাইছি না। এখানে রয়েছে সত্য ও স্বপ্নের ফারাক। স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতার স্পৃহা মানুষের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য এবং এসব প্রবৃত্তি দ্বারাই সে পরিচালিত। আমাদের নৈতিক বিবেচনায় এগুলো নেতিবাচক হলেও জীবজগতের নিয়মে জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার জন্য এগুলোর ভূমিকা ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ।

মানবমনে কু ও সু-র দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে ধর্মবেত্তারা অবহিত ছিলেন এবং ডারউইন প্রক্রিয়াটির বাস্তব ভিত্তি উদ্‌ঘাটন করেছেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের স্পৃহা কতটা প্রবল এবং সার্বিক রাষ্ট্রীয় সহায়তায় মানুষ কীভাবে সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক বছর বসবাস করার (১৯৭৪-১৯৯২) সুবাদে এটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সাত দশকের চেষ্টা সত্ত্বেও মানবস্বভাব তেমন কিছু বদলাতে পারেনি এবং শেষে পুঁজিতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছে।

তবে এটাই শেষ কথা নয়। ঐতিহাসিক বাস্তববাদের নিয়মে অন্তর্দ্বন্দ্বে জীর্ণ পুঁজিতন্ত্র একসময় সৃজনশীলতা হারিয়ে অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং আরেকটি সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বৈব ব্যর্থ রাষ্ট্র হলে, বলাবাহুল্য, পরবর্তী ‘আদর্শ’ রাষ্ট্রের ইউটোপীয় আদলও অদ্যাবধি কোথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, যেমনটি সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। ইদানীং সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সংকরায়ণ ঘটানোর একটা কথা কেউ কেউ বলছেন, যা আজও অনুকল্পের অধিক কিছু নয়। মানবস্বভাবের সঙ্গে লাগসই শোষণহীন, সংঘাতহীন সমাজ ইউটোপিয়ারও অধিক মনে হয়।

যা হোক, রামপাল ঘটনায় আবার ফেরা যাক। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর মনোভাব এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে যে পুঁজিতন্ত্র প্রাথমিক সঞ্চয়কালে প্রকৃতিকে কোনো ছাড় দেয় না এবং অঙ্গীকার সত্ত্বেও সাসটেইনেবল বা পরিপোষক উন্নয়ন কার্যকর করতে পারে না। দূরের রামপাল কেন, কাছের ঢাকা শহরের চারপাশই এই বাস্তবতার বড় সাক্ষী। পুঁজি প্রবল শক্তিধর একটি নির্মুখ সত্তা। ‘সুন্দরবন দেশের জন্য একটি প্রাকৃতিক রক্ষাপ্রাচীর’, ‘ম্যানগ্রোভ বন জীববৈচিত্র্যের জরায়ু’ ইত্যাদি সুললিত সারগর্ভ আহ্বান পুঁজির আগ্রাসী স্বভাবকে কিছুমাত্র নমনীয় করতে পারে না।

>গোটা বিশ্বের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার উপযোগী পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এখনো ঢের দেরি। পুঁজিবাদ অপেক্ষা উন্নততর এবং সমাজতন্ত্র অপেক্ষা বাস্তবতর সমাজকাঠামো উদ্ভাবন পর্যন্ত আমরা টিকে থাকব তো!

সুন্দরবনে তেল-গ্যাসের বড় মজুত আবিষ্কৃত হলে সে নির্দ্বিধায় গোটা বন ধ্বংস করে ফেলবে। পরিবেশবাদীরা অবশ্যই এ ধরনের আত্মঘাতী হঠকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবেন এবং সেই সঙ্গে সংগ্রাম করবেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্যও। কেননা, গণতন্ত্র না থাকলে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন সফল হবে না, যা হয়নি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীনে। কিছু পরিবেশবাদীর একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো তাঁদের হাতে বিকল্প উন্নয়নের কোনো মডেল নেই। সীমিত আয়তনের আমাদের এই দেশে ১৬ কোটি মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ইত্যাদি জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো জোগাতে হলে আমরা প্রকৃতিকে কতটা ছাড় দিতে পারব, তা বলা খুব কঠিন নয়।

সমস্যাটি এককভাবে বাংলাদেশের নয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল গোটা বিশ্বের। প্রকৃতিকে অবদমনের মাধ্যমেই মানবসভ্যতার নির্মাণ ও উন্নয়ন ঘটেছে। আজ প্রকৃতি সংহারমূর্তি ধারণ করেছে, আমরা একটি সম্ভাব্য মহাপ্রলয়ের আশঙ্কায় হতবুদ্ধি অবস্থায় আছি। কীভাবে এই গ্রহে মানুষসহ গোটা জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে, সে জন্য নানা বক্তব্য ও কৌশল উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু এগুলো কতটা নির্ভরযোগ্য, তা বলা কঠিন।

গোটা বিশ্বের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার উপযোগী পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এখনো ঢের দেরি। পুঁজিবাদ অপেক্ষা উন্নততর এবং সমাজতন্ত্র অপেক্ষা বাস্তবতর সমাজকাঠামো উদ্ভাবন পর্যন্ত আমরা টিকে থাকব তো!

দ্বিজেন শর্মা: নিসর্গবিদ, লেখক; উদ্ভিদবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক