স্বপ্নপুরীর বাড়িওয়ালা–বাড়িওয়ালিদের নামধাম

বাঙালি আদৌ পরশ্রীকাতর নয়—এমন অপবাদ কেউ তাকে দিতে পারবে না। প্রতিবেশীকে এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনে বাজার থেকে বাড়িতে আসতে দেখলে তার বুক জ্বালা করে। গ্রামের কেউ যখন একখানা চারচালা টিনের ঘর তোলে, তাতে অনেকের অন্তর্দাহ হয়। সেই বাঙালি যখন শোনে কানাডায় বা মালয়েশিয়ায় বা কোনো দূর দ্বীপদেশে বাঙালিদের অনেকে বেগমপাড়া, সাহেবপাড়া নামে উপনিবেশের পত্তন করেছেন, তাতে অনেকের হিংসায় বুক জ্বলতেই পারে। সাংবাদিকেরাও কারও ভালো দেখতে পারেন না। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষের হাঁড়ির খবর বের করতে চান।

গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে বিদেশে অর্থ পাচার ও কানাডায় বঙ্গীয় বিবিদের বেগমপাড়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এ ছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচার শুধু কানাডায় নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা।’

বিভিন্ন গণমাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে দুদক ও পাঁচ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বিদেশে অর্থ পাচার এবং কানাডায় বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে সংস্থাগুলো। দুদকের দাখিল করা প্রতিবেদনে পুরোনো তথ্য থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আদালত দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘পুরোনো কাহিনি বলে লাভ নেই। আমাদের আদেশের পর কী করেছেন, তা দেখতে চাই। তার একটা ফিরিস্তি দেন। যারা অবৈধভাবে দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটি জানতে চাই। নতুন কী করেছেন সেটা বলেন। নামধাম শুনছি, বহু টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। টিভিতে বাড়ি দেখি, পত্রিকায় বাড়ির ছবি দেখি। এঁরা কারা। তাদের নামটাও কি আমরা জানতে পারব না?’

মাননীয় বিচারপতির এই জিজ্ঞাস্য দেশের সতেরো কোটি মানুষেরও। বেগমপাড়া, সাহেবপাড়ার ওই স্বপ্নপুরীর সুরম্য ভবন কেউ ভেঙে দিতে চায় না, ওই সব বাড়ির গর্বিত ও গরবিনীদের পরিচয়টা শুধু জানতে চায়।

আগের দিনে পরিচিত ঘুষখোর অনেককে দেখেছি, অল্পস্বল্প ঘুষ খেয়ে কিছু জমিজমা কেনা ছাড়া খুব বেশি বিত্তবান হতে পারেননি। তা ছাড়া যাঁরা ঘুষ খেতেন, বোঝা যেত তাঁদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত, তা তাঁদের চেহারায় বা আচরণে বোঝা যেত। এখনকার দুর্নীতিবাজেরা বেপরোয়া।

সাত সমুদ্রের ওপারে গিয়ে রাজনীতিক হোন, কর্মকর্তা হোন, ব্যবসায়ী হোন, যাঁরা বাঙালি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেশে যে তাঁদের বাড়িঘর কিছু নেই, তা নয়। তবে রাজউকের চার-পাঁচ কাঠার একচিলতে জমির ওপর বাড়িতে তাঁদের মন ভরেনি।

আদালতকে দুদক থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। সিআইডি জানিয়েছে, সাতজন হ্যাকারের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে দুজন ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছেন।

আদালত বলেছেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষ, এর মধ্যে গুটিকয়েক মানুষ অর্থ পাচার করে। আমরা অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা জানতে চাই। এটা সবার জানার অধিকার আছে।’

বিভিন্ন সংস্থার উদ্দেশে বলেন, ‘যেসব সংস্থা আছে, তারা যদি সরকারকে সহায়তা করে, তাহলে কেন অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা জানা যাবে না? আদালতের কাজ হলো, সরকার ও জনগণকে সহযোগিতা করা।’

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সব কটি সংস্থাই চেষ্টা করছে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। কতগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, যে কারণে কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ নাম প্রকাশ করতে পারে না। গত অর্থবছরে বিএফআইইউ অর্থ পাচার বিষয়ে দুদককে ১০০টি, সিআইডিকে ৩২১টি, পুলিশকে ২৫৬টি, এনবিআরকে ৩০টি এবং অন্যান্য সংস্থাকে ১৬০টিসহ সব মিলিয়ে ৮৬৭টি প্রতিবেদন দিয়েছে। অর্থাৎ অর্থ পাচারকারীরা যেমন বসে নেই, আমাদের গোয়েন্দারাও বসে নেই।

দেশ থেকে অর্থ বিদেশে পাচার করা এক জিনিস, তা দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। তার শাস্তির বিধানও আইনে আছে। অলৌকিক উপায়ে অর্থ রোজগার আরেক জিনিস। আগে রোজগার, তার পরে তো পাচারের প্রশ্ন। অলৌকিকভাবে বস্তা বস্তা টাকা কামাই করার মতো বাস্তব অবস্থা রাষ্ট্রে রয়েছে বলেই অনেকে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন। ইচ্ছা করলেই দুর্নীতি করা যায় না, যদি উপযুক্ত পরিবেশ না থাকে।

আগের দিনে পরিচিত ঘুষখোর অনেককে দেখেছি, অল্পস্বল্প ঘুষ খেয়ে কিছু জমিজমা কেনা ছাড়া খুব বেশি বিত্তবান হতে পারেননি। তা ছাড়া যাঁরা ঘুষ খেতেন, বোঝা যেত তাঁদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত, তা তাঁদের চেহারায় বা আচরণে বোঝা যেত। এখনকার দুর্নীতিবাজেরা বেপরোয়া। তাদের কুচ পরোয়া নেই ভাবটা এমন যে ‘ধরা পড়লে পড়লাম, বিপুল কামাই করেছি, সেই অর্থের সমুদ্র থেকে কয়েক কলসি না হয় চলে যাবে।’

অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তার তথ্য সংগ্রহ করা গোয়েন্দাদের কাজ। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তকে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির মুখোমুখি করে। কিন্তু গোয়েন্দা ও পুলিশ পরিবেশের পরিবর্তন আনতে পারে না। সেটা তাদের কাজ নয়। ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া দুর্নীতি নির্মূল সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক দুর্নীতিবাজের সাজা হবে, দুই দুর্নীতিবাজের জন্ম হবে। অর্থ পাচারকারীদের সংখ্যা, পরিসংখ্যা ও অনুপাত দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২৮ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন রাজনীতিকরনেওয়ালা হলে কর্মকর্তা ও রাজনীতিকের অনুপাত দাঁড়ায় ৭ : ১। অর্থ পাচার করে বিদেশে বাড়িঘর যেকোনো পেশার লোকই করতে পারে—আদম ব্যবসায়ীও করতে পারেন, তুখোড় উপসম্পাদকীয় লেখকও পারেন।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইউরোপ–আমেরিকায় গিয়ে বাঙালিদের অনেকে বাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন। তাঁদের নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। তাঁরা সেখানেই টাকা কামাই করেছেন এবং তার কিছু দেশেও পাঠিয়েছেন। এখনকার কানাডা, মালয়েশিয়ায় আমাদের বাড়িওয়ালা–বাড়িওয়ালিরা দেশ থেকে শুধু নিয়েই যাচ্ছেন। একসময় পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা আমাদের দেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে তাঁদের দেশ সাজিয়েছেন। পরিহাসের মতো মনে হয়, আজ আমাদের লোকেরা নিজের দেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে তাঁদের দেশে স্বপ্নপুরী বানাচ্ছেন।

অর্থ পাচারকারীদের দেখতে হবে সংখ্যা দিয়ে নয়, নীতিগতভাবে। যদি একজনও ওই কাজ করেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং জনগণের সামনেও হাজির করতে হবে, যে কথা আদালত বলেছেন। দেশের সম্পদ পাচারকারীদের সরকার করবে বিচার আর জনগণ করবে তাঁদের ঘৃণা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক