স্বপ্নপূরণের কাহিনি

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন

আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের আটজন—সাত ভাই চম্পা, এক বোন পারুল। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমাদের কিছু স্বপ্ন ছিল। এরই ফসল ১৯৯৬ সালে সেগুনবাগিচায় ভাড়াবাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা। প্রস্তুতিপর্বেই সাথি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, আর গত দুই দশকে অংশী হয়েছেন এ দেশের লাখো মানুষ। আমাদের স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব ও সশস্ত্র যুদ্ধের গৌরব-বীরত্ব এবং বেদনা-নৃশংসতার সর্ববৃহৎ সংগ্রহশালা গড়ে তোলা। আজ আমাদের আর্কাইভে রয়েছে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের অবমুক্ত প্রামাণ্য দলিল-তথ্যাবলি থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের ব্যবহৃত সামগ্রী, যার বর্তমান সংখ্যা ১৫ হাজার।
তবে সেগুনবাগিচার স্বল্প পরিসরে প্রদর্শিত হয় মাত্র ১ হাজার ৩০০ স্মারক, যা নিয়ে স্মারকদাতাদের অভিযোগ রয়েছে। আমাদের স্বপ্ন ছিল প্রথাগত জাদুঘরের চিন্তাধারাকে পরিত্যাগ করে চার দেয়ালের বেষ্টনী পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া; জাদুঘর যেন কেবল অতীতাশ্রয়ী না হয়ে ভবিষ্যৎ–মুখী হয়ে ওঠে। তারা সবাই যেন অতীতের ঘটনাবলির আলোকে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করতে পারে, ভবিষ্যতের পথনির্দেশ পায়। ১৯৯৮ সালে শুরু হয় ঢাকা মহানগরীর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আউটরিচ প্রকল্প এবং ২০০২ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর অভিযাত্রা। জানুয়ারি ২০১৭ অবধি ৬৪ জেলার ২ হাজার ৮৮৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১২ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের ৩৮ হাজার সাক্ষাৎকার গ্রহণ
করে নিজেরাও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির অংশী হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি অধরা থেকে গিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আগারগাঁওয়ে প্রায় এক একর জমি সরকারি বাজারমূল্যে বরাদ্দ পাওয়া গেল, শেখ হাসিনার সরকার জমিটি হস্তান্তর করে ও নিজে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এগিয়ে এলেন স্থপতি সংসদের নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংস্থা, তৈরি হলো আন্তর্জাতিক জুরিবোর্ড। তারা ৭০টি নকশার মধ্যে স্থপতি তানজিম দম্পতির ডিজাইন অনুমোদন করল। প্রকল্প ব্যয় ১০২ কোটি টাকা। সেগুনবাগিচায় জাদুঘর পরিচালনার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা সরকারি বরাদ্দ ও জনসাধারণের সহায়তায় সম্ভব হয়েছে; কিন্তু নতুন ভবনের জন্য এত টাকা পাই কোথায়? বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান উদ্যোগী হলেন এবং প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য সব তফসিলি স্থানীয় ব্যাংকের কাছ থেকে স্বয়ং অর্থ গ্রহণ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এই প্রারম্ভিক অর্থপ্রাপ্তি ছাড়া ভূগর্ভের কাজটিও সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না।
ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে আমরা বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, তাই জনগণের সহায়তায় তাঁদের মালিকানায় এ জাদুঘর নির্মিত হবে। শতকোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত এই জাদুঘরে সরকারি বরাদ্দ ৪০ শতাংশ এবং জনসাধারণের অনুদান ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে যেমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট হাউস রয়েছে, তেমনি রয়েছে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে স্কুল থেকে টিফিনের টাকা বাঁচানো অর্থ। নেই কোনো বিদেশি অনুদান। নিচে তিনতলা বেসমেন্ট ও ওপরে ছয়তলা বৃহদাকার দুই লাখ বর্গফুটের বিশাল অট্টালিকা সর্বজনের সহায়তায় নির্মিত ও সজ্জিত হয়েছে। দেশে নানা নেতিবাচক ঘটনাপ্রবাহ সত্ত্বেও আমাদের মনে পুনরায় এ দৃঢ়প্রত্যয় জন্মেছে যে দেশের মানুষের যদি চাহিদা থাকে এবং যাঁরা অর্থ সংগ্রহ করছেন, তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন না থাকে, তবে আজও বাংলাদেশে কোনো বড় মাপের কাজ বন্ধ থাকে না। আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে নির্মাণ তহবিল ভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রতিবছর দাতা ও সবার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হচ্ছে।
এ সুবিশাল আধুনিক অট্টালিকার বেসমেন্টে রয়েছে শতাধিক গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, আধুনিক স্মারক সংরক্ষণাগার, দুটি সেমিনারকক্ষ, ওপরে মিলনায়তন, শিখা চিরন্তন (যা সেগুনবাগিচা থেকে ১৫ এপ্রিল পদযাত্রা করে নিয়ে আসা হয়েছে), লবিতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পেছনে চার নেতার ভাস্কর্য, কিয়স্ক, ক্যানটিন, আড্ডার এলাকা এবং লাইব্রেরি ও গবেষণাকক্ষ। প্রবেশপথে দেখা যাবে সাত বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণে স্তম্ভের ওপর বহ্নিশিখার আদলে তৈরি শিল্পকর্ম। প্রদর্শনী গ্যালারি জাদুঘরের মূল সম্পদ। গ্যালারি নিছক আলোকচিত্রের প্রদর্শনী নয়, প্রয়োজন পড়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলার ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞের ঘটনাপ্রবাহ দর্শনার্থীদের কাছে উপস্থাপন করার। সে জন্য ইতিপূর্বে জাদুঘর প্রদর্শনীতে অভিজ্ঞ একটি মার্কিন পরামর্শদাতা নিয়োগ করা হয়। তবে সব কাজ করেছেন জাদুঘরের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, তরুণ শিল্পী ও প্রযুক্তিবিদেরা, যাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন।
আজ ১৬ এপ্রিল ২০১৭, প্রধানমন্ত্রী শিখা চিরন্তন প্রজ্বালন করে নবনির্মিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দ্বারোদ্ঘাটন করবেন। আমাদের স্মৃতিধন্য সেগুনবাগিচার জাদুঘরের প্রায় ৭০ গুণ এ স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালনা ব্যয়সাধ্য। তবে ট্রাস্টি ও কর্মীরা আশাবাদী, সর্বজনের সহায়তায় এটিও অবশ্যই সম্ভব হবে। তবে ট্রাস্টিদের বয়স বেড়েছে, অনেকের শরীরে রোগবালাই দানা বেঁধেছে। যে তরুণসমাজ দেশে বিপুল কর্মযজ্ঞের চালিকাশক্তি, তাদের জাদুঘরের নেতৃত্বের অংশী হতে হবে।
সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।