স্বাগত হিজরি শুভ নববর্ষ ১৪৪২

ধর্ম

জীবন সময়ের সমষ্টি। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সময় তার আয়ু নির্ধারিত করে দেন। মানুষের বয়স যত বাড়ে, নির্ধারিত আয়ু ততটুকু কমে। নেক আমল, দান–খয়রাত, পিতা–মাতার খেদমত, গুরুভক্তি এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সেবা আয়ু বৃদ্ধির করে। আল্লাহ তাআলা সময়কে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন অংশে বিভাজন করেছেন। যেমন দিন, রাত, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর ইত্যাদি।

বছর বা বর্ষকে সাল, সন, অব্দ ইত্যাদি বলা হয়। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কাল হলো সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কাল হলো চান্দ্রবর্ষ। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আর সূর্য ও চন্দ্র হিসাব নিমিত্তে।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ৫)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর হিজরতের বছরকে ইসলামি সন গণনার প্রথম বছর ধরা হয়েছে বলে এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ—উভয় হিসেবে গণনা করা হয়। সৌর হিসাবে ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ দিনে মাস ও ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে বছর হয়; চান্দ্র হিসাবে ২৯, ৩০ দিনে মাস ও ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে বছর হয়। ইসলামি শরিয়তের ফিকহি বিধানগুলোতে মাস বলতে চান্দ্রমাস এবং বছর বলতে চান্দ্রবর্ষকেই বোঝায়।

স্বাগত হিজরি শুভ নববর্ষ ১৪৪২। তওবার মাধ্যমে বিগত জীবনের হালখাতা করে, অতীত ব্যর্থতার সব গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে নেক আমলের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হবে।

ইসলামের বিধিবিধান হিজরি সন ও চান্দ্র তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান ও আনন্দ–উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি–কালচারে ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইতিহাসবিদ আলবিরুনির বিবরণমতে, তৎকালীন মিসরের গভর্নর হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে হজরত উমর (রা.)–এর কাছে লেখেন, ‘আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে সন–তারিখের উল্লেখ নেই, এতে আমাদের অসুবিধা হয়।’ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে খলিফা হজরত উমর (রা.) একটি সন প্রচলনে সচেষ্ট হন। আল্লামা শিবলি নোমানি (র.) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আল ফারুক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)–এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। তীক্ষ্ণè দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞেস করেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল? অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু (হিজরি বর্ষ শুরু) করার পরামর্শ প্রদান করেন হজরত উসমান (রা.)। (বুখারি ও আবু দাউদ)।

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাস এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যে স্মৃতিগুলোর সম্মানার্থেই এ মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারো, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)। এই চার মাসের বৈশিষ্ট্য হলো যাঁরা বিশেষভাবে এ মাসগুলোতে ইবাদত–বন্দেগি করবেন, আল্লাহ তাআলা তঁাদের বাকি আট মাস ইবাদত করার তাওফিক দান করবেন এবং যাঁরা এই চার মাস নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন, তঁাদের জন্য বাকি আট মাস যাবতীয় পাপকাজ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এই চার মাসকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।

নতুন বছরে আসে নতুন চান্দ্রমাস। নবচন্দ্রে এ দোয়া পড়া সুন্নাত। ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতি য়াল ইসলাম; রব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।’ অর্থ ‘আল্লাহ সর্বমহান! হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪০০, রিয়াদুস সালেহিন: ১২৩৬)।

আগত সময়ের সব অকল্যাণ থেকে মুক্তি কামনা ও সবার প্রতি হিজরি শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com