স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীন হওয়ার যোগ্যতা

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে সমাবেশ
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে সমাবেশ

কয়েক সপ্তাহ যাবৎ স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়ার সংবাদ যখনই টেলিভিশনে দেখছি বা কাগজে পড়ছি, তখনই আমার মনে পড়ছে বাংলাদেশের একাত্তরের কথা। এই মনে পড়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তবে মানুষের অবচেতন মনের অনেক বিষয়ের ব্যাখ্যা করা কঠিন।

কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় কাতালোনিয়া। কোথায় পাকিস্তান আর কোথায় স্পেন। কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক নেই। কাতালোনিয়ার নাম আগে বাংলাদেশের মানুষ জানত না। তারা স্বাধীনতা চাইছে বলে দুনিয়ার মানুষ তাদের নাম জানছে। যেমন বায়াফ্রার নাম এখন বাংলাদেশের মানুষ জানে না, সবাই জানে নাইজেরিয়ার নাম। অথচ একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বায়াফ্রার কথা প্রতিদিন সংবাদপত্রে থাকত। বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের নাম জানত না, বায়াফ্রার নাম জানত। কাতালোনিয়া যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, তাহলে বিশ্বসভায় কাতালোনিয়ার স্থান হবে। আর যদি স্বাধীনতা অর্জনে অপারগ হয়, তাহলে কাতালোনিয়ার কথা মানুষ ভুলে যাবে। খেলাধুলার ব্যাপারে উৎসাহ যাদের, তারা কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনার নামটা উচ্চারণ করবে।

স্বাধীনতা যারা চায়, সাধারণত স্বাধীনতা তারা পায়। কেউ দ্রুত, কেউ দেরিতে। তবে চাহিবামাত্র স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের নেতা জি এম সৈয়দ চাইতেন সিন্ধু দেশের স্বাধীনতা। তাঁর বৈঠকখানার দেয়ালে দেখেছি সিন্ধু প্রদেশের একটি মানচিত্র টাঙানো। ঘরের মধ্যে মানচিত্র টাঙিয়ে এবং জনসভায় ভাষণ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। স্বাধীনতা পেতে প্রয়োজন কঠোর সংগ্রাম, সীমাহীন ত্যাগ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরিমেয় রক্তের। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। নেতারা অসামান্য কষ্ট করেছেন, অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছে লক্ষকোটি মানুষ।

শুধু কাতালোনিয়া নয়, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে আরও অনেক দেশের মানুষ। ফরাসিভাষী কুইবেক প্রদেশের মানুষ কানাডা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন পোষণ করছে অনেক দিন থেকে। সে স্বপ্নের কথা অনেকবার তারা জানানও দিয়েছে। কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। জনগণের একটি অংশের আগ্রহ কম। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়ার জন্য শান্তিপূর্ণভাবে চেষ্টা করেছে, এখনো করছে, আগামী দিনেও করবে। কিন্তু জনগণের একটি বড় অংশ মনে করে ‘বেটার টুগেদার’ বা একত্রে থাকাই ভালো।

ভৌগোলিকভাবে অখণ্ড দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীন হতে চাইলেও হওয়া যায় না। জি এম সৈয়দ বাঙালি নেতাদের অনুকরণ করেছেন, কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি যে তাঁর দেশটা বাংলাদেশের মতো পাকিস্তান থেকে এক হাজার এক শ মাইল দূরে নয়। কুইবেক, কাতালোনিয়া, কাশ্মীর, স্কটল্যান্ডের অবস্থাও একই রকম। কসোভোর ব্যাপার ভিন্ন। সেখানে বড় বড় বিশ্বশক্তি জড়িয়ে পড়েছিল। যদিও এখনো তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংহত নয়।

পাকিস্তান আমলে স্পেনের মুসলিম সভ্যতার কথা আমরা প্রায়ই শুনতাম। তা নিয়ে বহু বইপত্রও লেখা হয়েছে। স্বাধীনতার পর অত্যন্ত সেক্যুলার বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। মুসলিম মৌলবাদ সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিতৃষ্ণা ছিল সীমাহীন। কিন্তু স্পেনের মুসলিম সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল অপার। সেটা জানতে পারি তাঁর পত্নী আন-মারি ওয়ালীউল্লাহর কাছ থেকে। অবকাশ পেলেই তিনি প্যারিস থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে স্পেনে গেছেন। সেখানে তিনি মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, গ্রানাডা, কর্দোভা, সেভিল প্রভৃতি নগরী ও পল্লি এলাকা ঘুরে দেখেছেন। সেসব বিষয়ে আন-মারির কাছে শোনা কাহিনি আমি প্রথমা প্রকাশিত আমার স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বইতে লিখেছি।

পঞ্চম শতকের দিকে স্পেনে রোমান ক্যাথলিক ধর্মের বিস্তার ঘটে তখনকার শাসকদের আনুকূল্যে। কিন্তু ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে আরবের মুসলমানরা স্পেন অধিকার করেন। মুসলমানরা সেখানে যে সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তোলেন, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরহীন। মার্কিন ইতিহাসবিদ জন ভ্যান ডুইন সাউথওয়ার্থ তাঁর দ্য স্টোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে বলেছেন, সপ্তম ও অষ্টম শতকে মুসলমানরা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে সংস্কৃতিমান মানুষ—মোহামেডানস অব দ্য সেভেনথ অ্যান্ড এইটথ সেঞ্চুরিজ ওয়ার দ্য মোস্ট হাইলি সিভিলাইজড পিপল অব দেয়ার ডে। ওই সময় যখন পশ্চিম ইউরোপের মানুষ আদিমতা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন মুসলমান বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন আবিষ্কার করছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রে, রসায়নে, গণিতে, কৃষিবিজ্ঞানে ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে—হোয়াইল দ্য পিপল অব ওয়েস্টার্ন ইউরোপ ওয়ার সাঙ্ক ইন ডিপ ইগনোরেন্স অ্যান্ড বার্বারিজম, মোহামেডান সায়েন্টিস্টস ওয়ার মেকিং ইমপরটেন্ট নিউ ডিসকোভারিজ ইন মেডিসিন, ইন কেমিস্ট্রি, ইন ম্যাথমেটিকস, ইন অ্যাগ্রিকালচার, অ্যান্ড ইন অ্যাস্ট্রনোমি। [পৃ. ১৩২-৩৩]

যে তিন-চার শ বছর মুসলমানরা স্পেন শাসন করেন, তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের চরম দৃষ্টান্ত। মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা সমান মর্যাদায় নাগরিক সুবিধা ভোগ করেছেন। দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার চর্চা হয়েছে বিপুল। খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা পরস্পরকে কচুকাটা করেছে পরে।

তারপর একসময় খ্রিষ্টান শাসকদের কাছে মুসলিমদের পতন ঘটে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে স্পেন একটি উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়। দখল করে মেক্সিকো, পেরু, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও জার্মানির কিছু অংশ, কিউবা, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো। সে জন্য দক্ষিণ আমেরিকাকে বলা হয় স্প্যানিশ আমেরিকা।

তারপর একসময় শুধু আমেরিকা থেকে নয়, তাকে পাততাড়ি গোটাতে হয় কিউবা, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশ থেকে। কাতালোনিয়া তার দখল করা অঞ্চল নয়, ভূখণ্ডেরই অংশ। বহু ভাষাভাষী স্পেনে কাতালোনিয়ার মানুষের ভাষা কাতালান। তাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। সে জন্যই তারা স্বাধীন হতে চাইছে। যাহোক, সেটা তাদের ব্যাপার।

যাহোক, শুরুতে যেটা বলছিলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা, আর স্বাধীনতার জন্য কাতালানদের তৎপরতার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বড় বেশি মূল্য দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। কোনো জাতি যখন স্বাধীন হয়ে স্বতন্ত্র সত্তা গ্রহণ করে, তখন তার জাতীয় জীবনে আসে নতুনত্ব। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন ঘটে। জাতি হিসেবে বাঙালি পুরোনো, কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নতুন। বহু দেশের মতো আমাদের নতুন করে কিছু শেখার নেই।

সামাজিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার প্রভৃতি কোনো দেশের সংবিধানেই বানান করে লেখা থাকে না। রাজনীতির লক্ষ্য জনকল্যাণমূলক কাজ করে মানুষের মন জয় করা। গণতান্ত্রিক সমাজে পরস্পরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকবেই। কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের খাঁটি গণতন্ত্র না থাকুক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও যদি না থাকে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।

সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা থেকে নেতারা যদি দূরে সরে যেতে থাকেন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীন দেশের জনগণ যদি মনে করে, নেতারা যা বলছেন, তা সত্য নয় এবং সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, সেটা অতি দুর্ভাগ্যের। দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে কোনো ঘটনা ঘটছে, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তা মানুষ টেলিভিশনে ও পত্রিকার পাতায় দেখছে; কারা করছে, তা চর্মচক্ষুতেই দেখা যাচ্ছে, তারপর সে সম্পর্কে একেবারে মনগড়া একটা কথা ছেড়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক। জাতির সততার জায়গাটা যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে জনগণের গর্ব করার মতো আর কিছুই থাকে না।

স্বাধীন হওয়া মানে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের চেয়ে আরও সমৃদ্ধ হওয়া। নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে নির্মিত অবকাঠামো টেকসই হয় না। তার চেয়ে বড় কথা, যদি টেকসই হয়ও, তবু অবকাঠামোই একটি জাতির সব নয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান পৃথিবীর রাজধানী নগরীগুলোর মধ্যে একেবারে নিচের দিকে। বসবাসের অযোগ্য নগরীগুলোর মধ্যে একেবারে ওপরে তার স্থান। সে তো অতি অগৌরবের কথা! পাসপোর্ট বইটি দেশের মধ্যে কোনো কাজে লাগে না। দেশের বাইরে কোনো দেশে গেলে পাসপোর্ট ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। একটি রাষ্ট্র কেমন, তার পরিচয় তার পাসপোর্ট। কয়েক দিন আগে এক আন্তর্জাতিক জরিপের ফলাফল দেখে কষ্ট হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাসপোর্টের মর্যাদা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশেরটি সবচেয়ে নিচের দিকে। মূলত ভিসা ছাড়া ভ্রমণ বা সহজেই ভিসা পাওয়া যায় যেসব দেশের পাসপোর্টে সেগুলোর অবস্থানই ওপরের দিকে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিমানবন্দর ব্যবস্থায় ঢাকার অবস্থা শোচনীয়। জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনস বাংলাদেশ বিমান গ্রেডিংয়ে সবার নিচে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে একসময় কেউ প্রশ্ন তোলেননি, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান বিশ্বে দূরের কথা, দক্ষিণ এশিয়াতেই অত্যন্ত তলার দিকে। সে জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা যাবে না, স্বয়ং রাষ্ট্র দায়ী।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা একটি প্রাত্যহিক উচ্চারিত শব্দ। এই শব্দটি না বললে কেউ যে প্রবল দেশপ্রেমিক, তার প্রকাশ ঘটে না। চাকরির জন্য এই শব্দটির প্রয়োজন। ঘন ঘন প্রমোশনের জন্য এর দরকার। উঁচু পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য এর প্রয়োজন। সুবিধামতো জায়গায় বদলির জন্য দরকার। ষোলো-সতেরো কোটি মানুষের দেশ। এখানে নিম্নমানের জিনিস অবশ্যই অনেক থাকবে। কিন্তু অহংকার করার মতো একটি প্রতিষ্ঠানও থাকবে না, তার চেয়ে বেদনার ব্যাপার আর কী হতে পারে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বোঝা যায়, যখন তাদের প্রধান কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন না। নানাভাবে তাঁরা হন নাজেহাল, সমালোচিত, এমনকি আক্রান্ত। এসবে স্বাধীন দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। বহির্বিশ্বে দাম থাকে না। দেশের ভেতরে কোলাহল করে মর্যাদা বাড়ানো যায় না। স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।