স্বাধীনতার জন্য যিনি ছিলেন আত্মত্যাগে নির্ভীক

শাফী ইমাম (রুমী)
শাফী ইমাম (রুমী)

‘আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ কী বলেন, জানো? তিনি বলেন, “কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তস্নাত শহীদ।” অতএব মামণি, আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব—এ কথা ভেবে মনকে তৈরি করেই এসেছি।’
১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট মাকে উদ্দেশ করে বলা কথাগুলো ছিল এক সম্ভাবনাময় তরুণের, যার সামনে ছিল উজ্জ্বল ও
নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। মেধাবী তরুণটি স্টার মার্কসসহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭০ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ইতিমধ্যে আমেরিকার ইলিনয়েস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আইআইটি) তার ভর্তি সম্পন্ন হয়।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেওয়ার মাধ্যমে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করা হয়নি তার, কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করেছিল দেশবাসীর—নিজের জীবন দিয়ে দেশমাতাকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে।
প্রকৌশলী শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ সন্তান শাফী ইমাম (রুমী), বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী জন্মেছিল ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ। বাবা-মায়ের সুযোগ্য পরিচালনা ও নির্দেশনায় গড়ে ওঠা স্পষ্টভাষী, সাহসী ও দৃঢ়চিত্তের রুমী পরিণত হয় তারুণ্যের প্রতীকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ অত্যন্ত ঘৃণিত ও মানবতাবিবর্জিত পন্থায় সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয় ঘুমন্ত, নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর। নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই তীব্র শোককে অমোঘ শক্তিতে পরিণত করে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। দেশের এই চরম সংকটকালে রুমী আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
অনেক তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে মাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতিদানের জন্য রাজি করায় এই বলে যে ‘আম্মা, দেশের এ রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত, কিন্তু বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তা–ই চাও আম্মা?’ রুমীর সঙ্গে তর্কে না পেরে মা তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেন।
মা-বাবার আশীর্বাদ নিয়ে রুমী ১৪ জুন প্রশিক্ষণের জন্য মেলাঘরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে এবং সেখানে দেড় থেকে দুই মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। রুমীসহ অন্য কিছুসংখ্যক চৌকস ছেলেকে কমান্ডো টাইপ গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করেন ক্যাপ্টেন হায়দার। রুমী সেখানে সুপার এক্সপ্লোসিভে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করে। রুমী খুব বেশি দিন যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেনি। কিছু অ্যাকশনের সঙ্গে জড়িত থাকার পর ২৯ আগস্ট তারিখে সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২৫ আগস্ট তারিখের ধানমন্ডির অপারেশন। সেদিন রুমী আরও পাঁচজন গেরিলাসহ ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন সম্পন্ন করে। বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা হত্যার পর পলায়নকালে পাকিস্তানি আর্মিদের একটি জিপ তাদের গাড়িকে অনুসরণ করলে রুমী তার স্টেনগানের বাঁট দিয়ে পেছনের কাচ ভেঙে ফায়ার করলে চালক গুলিবিদ্ধ হয়, ফলে জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। রুমীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে সেদিন বাকি গেরিলা যোদ্ধাদের জীবন রক্ষা পায়।
এ ঘটনার চার দিন পর ২৯ আগস্ট রুমী, বদিউল আলম, আজাদ, জুয়েল, সামাদ, মাসুদ সাদেকসহ ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। রুমীকে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমসহ মোট পাঁচজনকে পাকিস্তানি বাহিনী তার বাসভবন কণিকা থেকে ধরে নিয়ে যায়। মেইন রোডে তাঁদের পাঁচজনকে লাইন করে দাঁড় করানোর পর ক্যাপ্টেন কাইয়ুম জিপের কাছে গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে এসে রুমীকে নিয়ে যায় একটি জিপে। শাহবাগের মোড় ঘুরে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে, এমপিএ হোস্টেলে গিয়ে গাড়ি থেকে নামার আগেই এখানে ইন্টেলিজেন্সের চিফ এসে জানতে চায়, ‘হু ইজ রুমী?’ এতে পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এতক্ষণ যা ঘটেছে, তা শুধু রুমীকে ধরার জন্যই।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রুমী তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কোনো কিছু স্বীকার করতে নিষেধ করে দেয় এবং সব দায়ভার নিজের ওপর নেয়। অনিবার্য পরিণতি অনুধাবন করে রুমী ধরা না–পড়া অন্য সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার জন্য অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে তাদের বেঁচে যাওয়ার জন্য রুমীর অবদানের কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
গতকাল ছিল সেই ২৯ আগস্ট। জাহানারা ইমাম দিনটিকে স্মরণ করেন এভাবে; ‘১৯৭১ সালের ২৯ আগস্টের সেই ভয়াল রাত্রির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই দিব্যকান্ত মুখজ্যোতি ছিনিয়ে নেওয়ার দৃশ্য। পাকিস্তানি হানাদাররা গভীর রাতে আমার বাসায় এসে রুমীকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন ওর গায়ে ছিল টি-শার্ট। কথা ছিল ফিরিয়ে দেবার, কিন্তু দেয়নি। স্পষ্ট মনে পড়ে সেই নিষ্পাপ, শান্ত, উদীয়মান এক যুবকের কঠিন দেশপ্রেমের ধীরস্থির মুখচ্ছবি। আমি সেদিন ওর স্বচ্ছ চোখে স্বাধীন দেশের পতাকা দেখেছিলাম।’
আবিদ হোসেন: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।