স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মকসুদ ভাইয়ের অভাব বিশেষভাবে অনুভূত হবে

সৈয়দ আবুল মকসুদ(১৯৪৬–২০২১)
ছবি: প্রথম আলো


সকালে আমার সহকর্মী মানোয়ার জানাল, মকসুদ ভাই, সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার প্রকাশিতব্য বইয়ের ভূমিকাটা এখনো লিখে উঠতে পারেননি। আমি যেন তাঁকে একটু তাগাদা দিই, কথা বলি। সেই চিন্তা থেকে রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে ফোন দেব, ফোন বের করেছি এমন সময় মানোয়ারের আবার ফোন, আমি মকসুদ ভাইয়ের কোনো খবর জানি কি না। সে ডেইলি স্টার-এর লিংকে একটা খবর দেখেছে মকসুদ ভাই নেই বলে। তাড়াতাড়ি মোবাইলে ফেসবুক দেখা শুরু করলাম। কারণ, জানতাম সে ধরনের কোনো দুর্ঘটনা হলে ফেসবুক থেকে তাঁর খবর পাওয়া যাবে এবং পাওয়া গেল।

অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু আমার লেখার হাত উঠছিল না। কারণ, আমার বইয়ের ভূমিকা কেবল নয়, আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিকল্পনা হয়েছিল। অবশ্য করোনার কারণে মুখোমুখি দেখা হয়নি, এমনকি জুমের মাধ্যমেও নয়। অথচ এর আগে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে দেখা হতো। আমাদের পার্টি অফিসেও মাঝেমধ্যে আসতেন। তবে লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে এত ব্যস্ত থাকতেন যে সেটাও বেশি হয়ে উঠত না। তবে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ফোনে যোগাযোগ হতো।

সম্প্রতি তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বইমেলাকে সামনে রেখে প্রকাশনা সংস্থার প্রথমার জন্য মাওলানা ভাসানীর ওপর একটা বইয়ের প্রুফ দেখা নিয়ে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের স্মারক গ্রন্থের পুরো দায়িত্ব ছিল তাঁর। আমার কাছ থেকে একটা লেখাও নিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি যে বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর বিশেষ কথা হয়েছিল, তা হলো মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, তা অপনোদনের জন্য যৌথভাবে ‘মাওলানা ভাসানীর সত্য-অসত্য’ নামে একটা বই লেখার।
কেবল তা-ই নয়, ওয়ার্কার্স পার্টির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচিতে মাওলানা ভাসানীর মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রধান আলোচক থাকার কথা হয়েছিল। সেভাবে হলও ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে তাঁর সঙ্গে মিলে সেই বই লেখা যেমন হবে না, তেমনি আমাদের সবার ও জাতির দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার সঞ্চালনায় ভাসানীর অনন্য ও অগ্রগামী ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্যাবলি জানা যাবে না। তবে আশার কথা প্রথমা যদি তাঁর বইটা প্রকাশ করে, তবে অনেক অজানা বিষয় আমরা জানতে পারব এবং মাওলানা সম্পর্কে যাঁদের কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, তাঁদের নাক উঁচু মনোভাব, তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা কিছুটা হলেও দূর হবে।

ইরাকে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি পশ্চিমা পোশাক ছেড়ে দিয়ে সাদা কাপড়ের বেশ নিয়েছিলেন। অনেকে এটা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে তাঁর প্রতিবাদে আমৃত্যু অটল ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত পরিহিত পোশাক

কেবল মাওলানা ভাসানী সম্পর্কে নয়, মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কেও বহু অজানা কথা আমরা মকসুদ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি এবং এ জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। জেনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে। জেনেছি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বুদ্ধদেব বসুর সম্পর্কেও। আরও অসংখ্য বিষয় সম্পর্কে জেনেছি, যা ছড়িয়ে আছে তাঁর ৪০টির বেশি বই ও অসংখ্য কলামে।

তবে মকসুদ ভাইয়ের লেখক-গবেষক-সাংবাদিক সত্তার বাইরে আর একটি সত্তা সবার কাছে পরিচিত, তা হলো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সেটা সড়ক দুর্ঘটনা, নদীদূষণ, পরিবেশ রক্ষা, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা, যা-ই হোক না কেন। এসব অসংখ্য বিষয়ে তাঁর প্রতিবাদী অবস্থান। তাঁর কলাম লেখার ব্যাপারে আপত্তি করায় তিনি প্রতিবাদে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার উপবার্তা সম্পাদকের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তেমনি ইরাকে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি পশ্চিমা পোশাক ছেড়ে দিয়ে সাদা কাপড়ের বেশ নিয়েছিলেন। অনেকে এটা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে তাঁর প্রতিবাদে আমৃত্যু অটল ছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত পরিহিত পোশাক। সেই সাদা কাপড় পরিধান করে তিনি অন্তিম শয়ানে গেলেন। কিন্তু তাঁর ওই পোশাকের ঔজ্জ্বল্যই তাঁকে সবার থেকে পৃথক করে মানুষের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। যেকোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনায় তাঁর প্রতিবাদী চেহারা দেখেছি। তাঁর লেখায়, চলায়-বলায় এটা স্পষ্ট ছিল। ফেসবুকে একটা পোস্টে তাঁকে প্রশংসাবাক্যে ভাসিয়ে দেওয়ার পরও তাঁকে ‘বামাতি’ বলে উল্লেখ করে তাঁর ওই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এটা কেন জানি না।

তবে মকসুদ ভাই কেবল একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিই ছিলেন না, তিনি তাঁর সময় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই যে বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই, তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই মহতী ভাবনা আমরা অনুভব করব।

রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশর ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি