স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এলোমেলো দুই সপ্তাহ

গত প্রায় দুই সপ্তাহে দেশে অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। অবশ্য বড় কোনো ওলট–পালট নয়। বড় ওলট–পালট হয়েছে আফ্রিকার দেশ নাইজারে। ২ এপ্রিল এ মোহাম্মদ বাজুমি ‘নির্বাচনে’ জিতে নাইজারের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন। নাইজার ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ৬০ বছর পর এই প্রথমবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটল। অবশ্য শপথের দিন দুয়েক আগেও গোটাকয় সেনাসদস্য প্রেসিডেন্ট ভবন লক্ষ্য করে কিছু গোলাগুলি ছুড়েছিলেন। ক্ষমতাবদলের এটাই সে দেশে রেওয়াজ। তাই নির্বাচনে জিতে শপথ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পালা ওই দেশের জন্য ওলট–পালট তো বটেই।

এলোমেলোতে ফিরে আসি। গত ১৭ মার্চ যথাযোগ্যভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন পর্ব শুরু হয়েছিল। ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে দুনিয়ার অনেক বাঘা বাঘা দেশের বিরাট বিরাট রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বাণীতে আমরা মোহিত হয়েছি। ওই সব দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা ভালো কাজই করেছেন। পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা তশরিফ এনেছিলেন। আমরা খুশি। বিশেষত, গত পাঁচ-ছয় বছরে ওই গোছের বিদেশি মেহমান তেমন তো কেউ আসেননি। উদ্‌যাপন পর্বটা ভালোই যাচ্ছিল। তবে অনুষ্ঠানমালা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। শেষ দিনে কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত চাঞ্চল্য আনল নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি।

অবশ্য এই চাঞ্চল্য অনুষ্ঠানসূচির আয়োজকদের পরিকল্পনায় নিশ্চয়ই ছিল না। বামপন্থী আর হেফাজতিদের উপস্থিতি ও ভূমিকা নিশ্চয়ই আমলে নেওয়া হয়নি। পুরো পর্বটার আয়োজন সম্ভবত করা হয়েছিল কেবল সরকার ও সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। করোনার কারণে আয়োজনগুলোর আয়তন ছিল সীমিত আর তাই সরকারের বাইরে কাউকেই সুযোগ দেওয়ার উপায় ছিল না। গায়ক-বাদক, মেহমান-অতিথি, শ্রোতা-বক্তা—সবই এক ঘরানার। পুরো জাতির এক বৃহদাংশ এই বিরল উৎসবের বাইরে রয়ে গেল। এলোমেলো হয়ে গেল বামপন্থী আর হেফাজতিদের জোর করে অনুষ্ঠানটিকে বাধা দিয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। পুলিশ আর সরকারি দলের লোকজন নিকট অতীতে যেভাবে সবকিছু প্রতিহত করে, সে একই কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে ব্যাপারটা আরও ঘোলাটে করে ফেলল।

হেফাজতি তাণ্ডবের রূপ আমরা আবার দেখলাম, বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সরকারকে বুঝতে হবে যে আমাদের কাছে যা মূল্যবান, যেমন বইপত্র, সংগীত, সরকারি অফিস, রেলসহ রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো—এর কোনো কিছুই ওদের কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আমাদের কাছে যা প্রিয় ও মূল্যবান, ওদের কাছে ওই সবকিছুই ধ্বংসযোগ্য।

এলোমেলো ও ওলট–পালট কতটা তুঙ্গে উঠেছে, সেটার আভাস মিলল পুলিশের ৪৩ মামলায় ২০ হাজার মানুষকে আসামি করা থেকে। স্পষ্টতই আমরা ফৌজদারি আইন যেভাবে বুঝি, আইনের উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে আমাদের ধ্যানধারণার সঙ্গে পুলিশি চিন্তার কোনো মিল নেই। গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ যদি কোনো ফৌজদারি মামলায় ১০ জনকে আসামি করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, আর শেষতক বিচারে ৭ জন আসামি খালাস পান, তাহলে মামলায় জড়িত পুলিশগুলোর চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। সাতজন নির্দোষ নাগরিককে অহেতুক ফৌজদারি ব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষণ করার জন্য আর আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত অনেকেই, বিশেষত সরকারি লোকজন ভাবেন উল্টো। বিচার ও মামলার নামে যত বেশি লোককে ‘জাঁতা’ দেওয়া যায়, তত বেশি মঙ্গল। অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

এলোমেলোগুলো দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও চলে গেছে। মিয়ানমারে বর্তমান কালে ভীষণভাবে দেশনিবেদিত সেনাবাহিনীর মহা আড়ম্বরের অনুষ্ঠানে কুল্লে আরও সাতটা দেশের সঙ্গে আমাদের সামরিক অ্যাটাশেও যোগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমরা প্রমাণ করার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিলাম মিয়ানমারের এই সময়ের মহান সেনাবাহিনী আমাদের কত কাছের। গত দুই মাসে মিয়ানমারের এই মহান সেনাবাহিনী অন্তত ৪০টি শিশুসহ নিজের দেশের পাঁচ শতাধিক নাগরিককে হত্যা করেছে। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছি। তাই এই সপ্তাহে মিয়ানমারের শত শত নিপীড়িত জনগণ পালাচ্ছে থাইল্যান্ডে।

যুদ্ধাপরাধের জন্য শ্রীলঙ্কায় জাতিসংঘের অনুসন্ধানের বিপক্ষে বাংলাদেশ ভোট দিল। ভোটাভুটিতে ভারত-নেপালের মতো ভোটদানে বিরত না থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ ভোট দিল শ্রীলঙ্কা সরকারের পক্ষে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গত ৩১ মার্চ ‘বাংলাদেশের দুই অদ্ভুত কূটনৈতিক কাণ্ড’ শিরোনামে অতি চমৎকার কলাম লেখেন। পরদিন সম্ভবত তৌহিদ হোসেনের লেখার প্রতিক্রিয়াতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটাও ছিল এলোমেলো। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।

সরকারের উপায় নেই, শিক্ষাঙ্গনে ছুটি আবার বাড়াল। এটা এলোমেলো পর্ব নয়, কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি এলোমেলোর যে ঝাপটা পড়েছে, সে সম্পর্কে সরকার ওয়াকিবহাল বলে মনে হচ্ছে না। গত কয়েক মাসে কদাচিৎ শিক্ষামন্ত্রীকে টেলিভিশন সংবাদে মোটামুটি দু-তিনটি কথা বলতেই শুনেছি পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, হোস্টেল-হল খোলা-বন্ধ, অনলাইনে পাঠদান ইত্যাদি ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনো এত দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকেনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ছাত্রছাত্রীরা এত দীর্ঘ সময় কখনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকেনি। শিক্ষকদের অবস্থা কোনো অংশেই কম করুণ নয়। অনেক প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এই অভূতপূর্ব ও গভীর সমস্যার নিরসনে, অর্থাৎ স্কুল-কলেজ খুললে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোন পথে এগোতে হবে, এই সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা, চিন্তাভাবনার কোনো আভাস পাচ্ছি না। সরকার আর শিক্ষাঙ্গনে জড়িত ব্যক্তিরা কি কিছুই অনুধাবন করতে পারছেন না?

বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে পড়াচ্ছি ৪০ বছর ধরে। এখন স্নাতকোত্তর কোনো ছাত্রছাত্রীর হাতে একটা বই দিয়ে যদি প্রশ্ন করেন যে বই না খুলে আন্দাজ করে বলো এই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা কত হতে পারে, তাহলে আশঙ্কা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীরা আপনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে।

শিক্ষার মান গভীরভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট সিরিজ ও শেষ টি-টোয়েন্টির ফলাফল ক্রিকেটামোদী সব পাঠকই জানেন। ক্রিকেটও এখন ভীষণভাবে এলোমেলো। সংক্রমণের হার ৫, ৬ হাজার ছাড়িয়ে ৭, ৮, ৯, ১০ হাজার হবে সম্ভবত আগামী কয়েক দিনেই। হাসপাতালে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এর কারণ স্পষ্টত একটাই, সরকার যা বলে, তাতে লোকের মোটেও আস্থা ও বিশ্বাস নেই। কেন আস্থা ও বিশ্বাস নেই, সেটাও আমরা সবাই জানি। কিন্তু কেউ কথা বলি না আকারে-ইঙ্গিতে ছাড়া। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, রমজানে ভূরিভোজ দারুণভাবে বেড়ে যায়। প্রায় হিসাবে বলা হয় সাধারণ মাসে কোনো ভোজ্য বস্তুর চাহিদা যেখানে এক লাখ টন, রমজানে তা গিয়ে দাঁড়ায় দুই থেকে তিন লাখ টনে। অতএব দাম আরও বাড়বে। সিন্ডিকেট ব্যবস্থা প্রতিবছরই আরও বেশি পাকাপোক্ত হয়। চাঁদাবাজিও বাড়বে। সিন্ডিকেট ব্যবস্থা আর চাঁদাবাজি ঐতিহাসিকভাবেই সরকারি দলের একচ্ছত্র অধিকার। সরকার যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, এই অধিকার তত সুদৃঢ় হয় এবং আসছে দিনগুলোতেও কোনো ব্যতিক্রম হওয়ার আশঙ্কা করছি না।

১৭ মার্চ শুরু হওয়া কিছু উৎসাহ ও উদ্দীপনার দিনগুলোর প্রত্যাশা ভীষণভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে। উটপাখির মতো বালুতে ঠোঁট গুঁজে দিয়ে আর অন্যরা দেশকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে—এই গৎবাঁধা বুলি দিয়ে আর নিকট ভবিষ্যতের আরও এলোমেলো দিনগুলোর আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা যৌক্তিক হবে না।

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক