স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে কতটা নিরাপদ?

প্রতিনিয়তই আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প, নির্মাণসামগ্রী, শিল্প-কলকারখানা, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ বড় বড় সব স্থাপনা। আমরা এগিয়ে চলেছি এক নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের প্রকল্পে—প্রতিযোগিতা বললেও ভুল হবে না। স্থাপনাগুলো দেখলে যে কারও মনে ধারণা হতে পারে কে কার ওপর দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, কে কার চেয়ে বেশি সুন্দর আর চকচকে হতে পারে, কোন স্থপতি কত সুন্দর স্পেস (স্থাপত্যের ভাষায়) তৈরি করতে পারে কিংবা কার বিক্রয়মূল্য কত বেশি হতে পারে—এসব ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আমরা সবাই।
আমরা বিভিন্ন সৃষ্টিশীল নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জন্য যে আবাসস্থল অথবা বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প তৈরি করে যাচ্ছি, যেখানে আমরা পুরো দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি, স্বাস্থ্যগত দিক থেকে সেটি কতটা নিরাপদ, তা বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি। প্রথমেই আসা যাক আমাদের পোশাক কারখানাগুলোর কথা, বর্তমানে যার ওপর আমাদের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এসব শিল্প-কলকারখানার প্রধান উৎপাদন স্থানগুলোতে শত শত শ্রমিক তাঁদের সারাটা দিন অতিবাহিত করেন শুধু অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে।
সকাল থেকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের। যেকোনো কারণে যদি উৎপাদন স্থানটির স্বাভাবিক তাপমাত্রা শ্রমিকদের দৈহিক তাপমাত্রা থেকে অধিক মাত্রায় বেশি হয়ে থাকে এবং সেখানে যদি কোনো প্রকার তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা না থাকে, তাহলে দিনের পর দিন পোশাককর্মীরা সেই অত্যধিক তাপমাত্রায় কাজ করতে থাকলে এর প্রভাব তাঁদের শরীরের ওপর পড়ে, যার দরুন ‘হিটস্ট্রোক’-এর মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তাদের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে অতি দ্রুতগতিতে। এমনকি পোশাককর্মীরা কাজভেদে কেমন ধরনের পোশাক পরে কাজ করবে, যাতে করে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকে—এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক দিকনির্দেশনা থাকলেও নকশা প্রণয়নকল্পে কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী সময়ে দ্রব্য উৎপাদন সময়কালে আমাদের দেশের কারখানাগুলোতে সব সময় এটি মানা হচ্ছে না।
কারণ, পরিধেয় পোশাকের একটি নির্দিষ্ট তাপনিরোধক মানদণ্ড আছে, যাকে ‘ক্লদিং থার্মাল ভ্যালু’ (Clothing Thermal Value) বলে, যার ওপর কারখানাটির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে এ কথা ঠিক যে বয়স-স্থান আর কাজের ধরন অনুযায়ী আমাদের সেই মাপকাঠি কী হবে, তার সঠিক নিজস্ব গবেষণা এখন পর্যন্ত আমাদের মাঝে নেই, যার প্রয়োজনীয়তা আমাদেরই অনুধাবন করতে হবে। কারণ, শুধু ভিনদেশি উপাত্ত যেগুলোকে আমরা স্ট্যান্ডার্ড মানদণ্ড মেনে ব্যবহার করছি, সঠিক গবেষণার মাধ্যমে শুধু আমাদের দেশের জন্য সেগুলোর ধরন খুঁজে বের করতে হবে, যা বর্তমানে সব উন্নত দেশে বিদ্যমান।
স্থান, কাল আর জলবায়ুর তারতম্যের কারণে সেই সব উপাত্ত অঞ্চলভেদে ভিন্নতর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, স্থাপনা নির্মাণকল্পে আমরা বর্তমানে যেসব উপকরণ ব্যবহার করছি (ইট, সিমেন্ট, কাচ, রং ইত্যাদি) যেগুলোর প্রায় সবগুলোরই সঠিক কোনো তাপ পরিবহনক্ষমতার তথ্য-উপাত্ত নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে। কিন্তু এমনও দেখা গেছে, না জেনে না বুঝে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই তাদের উপকরণগুলোকে ‘গ্রিন’ বলে সংজ্ঞায়িত করছে এবং নির্দ্বিধায় বাজারজাত করছে, যা অত্যন্ত চিন্তার বিষয় বৈকি! আর সে কারণেই এসব উপকরণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেড়ে যায়, যার পরিবেশগত কারণে উক্ত স্থাপনায় অবস্থানরত জনমানবের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায় অধিক মাত্রায়।
এখন দিন বদলে যাচ্ছে। এখন আর শুধু সুন্দর নকশা প্রণয়নই সবকিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে মাথায় রাখতে হবে আমাদের দেশের স্থপতি আর প্রকৌশলীদের একটা বিশেষ অংশের। প্রণয়ন করতে হবে নিজেদের স্থাপনা আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নিজস্ব কোডিং সিস্টেম, যা কিনা আমাদের জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আমাদের দেশে যে নির্মাণ বিধিমালা বর্তমান রয়েছে, তার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কিছু গবেষণা মানদণ্ড সংযুক্ত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট বলছি এই কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিধিমালায় লেখা রয়েছে ‘প্রয়োজনীয় বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে’—এখানে প্রশ্ন হলো সেই প্রয়োজনীয় বায়ুপ্রবাহ বলতে কোন ধরনের স্থাপনার জন্য কমপক্ষে কতটুকু পরিমাণ, সেটি সুস্পষ্ট গবেষণা থেকে সরাসরি উপস্থাপিত করতে হবে, আর এটি হলেই আমাদের দেশের স্থপতি আর প্রকৌশলীরা এ থেকে উপকৃত হবেন নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে।
বর্তমানে যেমন নিরাপদ অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব আরোপ করেছে, ঠিক তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ জনস্বাস্থ্যঝুঁকির কথাও মাথায় রাখতে হবে। কেননা, এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে ইট-কাচের খাঁচা বানানো উচিত হবে না, যেখানে বসবাসকারী জনজীবন ধুঁকে ধুঁকে মরে দিনের পর দিন অথবা মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল দেখে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। আর এ জন্য চাই প্রকল্প প্রণয়নে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা অবশ্যই সঠিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে হতে হবে। কিন্তু এ কথা সত্য যে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত স্থাপত্যচর্চায় এ বিষয়গুলোকে পর্যাপ্ত গবেষণায় আনা হচ্ছে না, তার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রয়োজনীয় গবেষণাগার আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবকে। আমরা যদি এ সমস্যাগুলোকে অচিরেই কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে খুব অল্প সময়কালেই একটি স্বাস্থ্যসম্মত সুনিশ্চিত পরিবেশ এবং কর্মক্ষেত্র উপহার দেওয়া যাবে দেশকে।
সজল চৌধুরী: (বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেমের ওপর গবেষণারত); সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
[email protected]