স্বৈরতন্ত্রের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে গেছে

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কোছবি: রয়টার্স

সব স্বৈরশাসকই কোনো একটা পরিস্থিতিতে এসে নিজের রচিত মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। বেলারুশ প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো এখন সেই অবস্থায় আছেন। তিনি এখন যে আচরণ করছেন ও হাবভাব দেখাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে, তিনি সত্যি সত্যি ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এবং ভোট জালিয়াতি বা কারসাজির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দেশটির বিভিন্ন শহরে যখন ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হচ্ছিল, তখন তিনি ১৭ আগস্ট রাজধানী মিনস্কের ‘মিনস্ক ইহুলড ট্রাক্টর প্লান্ট (এমজেকেটি) এবং মিনস্ক অটোমোবাইল প্লান্ট (এমএজেড) নামের দুটি গাড়ি তৈরির কারখানা পরিদর্শন করছিলেন। এই দুটি কারখানা শুধু দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বড় ভূমিকা রাখে তা নয়, বরং কোম্পানি দুটি বেলারুশদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। লুকাশেঙ্কোর ক্ষমতায় থাকার ভিত্তি গড়ার পেছনেও এই দুটি কোম্পানির ভূমিকা আছে। মিনস্কের সোশ্যালিস্ট স্ট্রিটে এই কোম্পানি দুটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা আছে। সেই হাউজিং কমপ্লেক্স যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন, এসব কর্মকর্তা–কর্মচারীর ওপর সরকারের আলাদা আনুকূল্য আছে।

অবাক করা বিষয় হলো, এই কারখানায় গিয়ে লুকাশেঙ্কো যখন কর্মীদের প্রতি তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানালেন, তিনি স্বভাবতই আশা করেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে ‘আমরা আপনার সঙ্গে আছি’ স্লোগান শোনা যাবে। কিন্তু তাঁরা তা না বলে স্লোগান তুললেন, ‘উখাদি!’ মানে, ‘ভাগো!’। এমনকি ‘শুট ইয়োরসেলফ!’(নিজেকে নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করো!) বলেও কেউ কেউ চেঁচিয়েছেন। এ ঘটনার মধ্যে লুকাশেঙ্কো ঐতিহাসিক যোগসূত্র খুঁজে দেখতে পারেন। রোমানিয়ার স্বৈরাচার শাসক নিকোলাই চসেস্কুকে উৎখাত করতে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে জনতা যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল, তখন তিনি তাঁদের নিয়ে মশকরা করেছিলেন। কিন্তু তার পরপরই তাঁর পতন হয়েছিল।

লুকাশেঙ্কোর দিকে বিদ্রূপ ছুড়ে দেওয়া শ্রমিকেরা তাঁর কঠোর কর্তৃত্ববাদকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। ‘আমিই তোমাদের সচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তাদানকারী, আমার বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলো না’—লুকাশেঙ্কো এত দিন ধরে জনগণকে এটি বোঝাতে চাইছিলেন। শ্রমিকদের বিদ্রূপ ও দুয়োধ্বনি প্রমাণ করেছে, তাঁর সেই বার্তা তাঁরা নেননি। লুকাশেঙ্কোর আচরণে মনে হচ্ছে তিনি নিজেও এই কথা বিশ্বাস করেন। আর এ কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী ও ওই নেত্রীর টিমের তিন নারীকে লুকাশেঙ্কো ‘রাজনৈতিক ধারণারহিত নির্বোধ বালিকারা’ বলে অবজ্ঞা করেছেন। অতি আত্মবিশ্বাসী থেকে দাম্ভিক হয়ে ওঠার কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকে তিনি শক্তি প্রয়োগ করে দমন করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু বেলারুশের সমাজ ভয় পায়নি। সব শ্রেণির মানুষ বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করেছে। চিকিৎসক, শিল্পী, কৃষক—সবাই ফুল হাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেছেন। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়েছেন। বহু পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের কর্মীরা রাস্তায় নেমে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিক্ষোভ থেকে বোঝা যাচ্ছে, শ্রমিকশ্রেণির সমর্থন এখন আর তাঁর প্রতি নেই। তাঁর সমর্থনে কিছু লোক সমাবেশ করলেও বিরোধীদের সংখ্যার কাছে তাদের উপস্থিতি গৌণ হয়ে পড়েছিল। রাজধানী ও তার আশপাশে লাখ মানুষের বিক্ষোভ ইতিমধ্যেই কার্যত লুকাশেঙ্কোকে বহিষ্কার করেছে।

লুকাশেঙ্কোর অনেক ভুল সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের কথা শুনছেন না এবং তাঁদের অনেকেই সম্ভবত এখন নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শঙ্কিত হতে শুরু করেছেন। সম্ভবত আমরা এমন একটি মুহূর্তের দিকে যাচ্ছি, যখন উপদেষ্টারা তাঁকে ছেড়ে হয় জীবন বাঁচাতে বিক্ষোভে যোগ দেবেন, নয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। বেলারুশের সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা জিয়াজদা বলেছে, দেশটির তথ্যমন্ত্রী তাদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, তাদের যে সাংবাদিকেরা বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বরখাস্ত করে সেখানে সরকারের পছন্দের সাংবাদিক নিতে হবে। কিন্তু জিয়াজদা এ নির্দেশ মানেনি।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বেলারুশের এই গণ–আন্দোলন কোনো সুনির্দিষ্ট নেতা ছাড়াই ফুঁসে উঠেছে। এটা ঠিক যে আন্দোলনে অনেক অ্যাকটিভিস্ট আছেন, লুকাশেঙ্কোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী সিয়াতলানা তিখানোভোস্কায়া ও অন্য নেতারা আন্দোলন এগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এদের কেউ নিজেকে আন্দোলনের নেতা হিসেবে দাবি করেননি। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এতে সমাজের সব স্তরের মানুষ যোগ দেওয়ায় লুকাশেঙ্কো বুঝে উঠতে পারছেন না আদতে কাকে কাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। শ্রমিকদের ধর্মঘট তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দিয়েছে। নারীদের আন্দোলন দেখিয়েছে দাঙ্গা পুলিশেরা লুকাশেঙ্কোর দন্তহীন বাঘ। অর্থাৎ পুরো একনায়কত্ব এখন একটা নড়বড়ে খুঁটির ওপর কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে পারবেন কি না,সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি পোল্যান্ডের ওয়ারশতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের পরিচালক