সড়ক বিভীষিকায় করোনা আতঙ্কও কুপোকাত

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে মহাসড়কের পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস। নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ৬ মার্চ। ছবি: ছবি: সংগৃহীত
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে মহাসড়কের পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস। নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ৬ মার্চ। ছবি: ছবি: সংগৃহীত

রোজ সাতসকালে অফিসে আসতে আসতে ভাবি, আজ যেন কোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর পড়তে না হয়। ঘর থেকে কোনো মানুষ সুস্থ শরীরে বের হয়ে যেন সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজনদের বিয়োগ–ব্যথার কারণ না হোন। কিন্তু ভাবনা আর দুর্দৈবের সঙ্গে বৈরিতা ঠেকাবে কে? একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবরে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সড়কে যেন আজ প্রাণসংহারী যজ্ঞ শুরু হয়েছে। এর বিভীষিকার কাছে করোনাভাইরাসের আতঙ্কও যেন তুচ্ছ।

সকালবেলায় আজ অফিসে পা দিয়েই পেলাম সড়কে ছয়টি তরতাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার খবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে যাত্রীবাহী বাস আর মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে মাইক্রোতে আগুন ধরে যায়। দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন ছয়জন। ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। সড়ক বিভীষিকা আমার কাছে ছায়াবৎ ফেউয়ের মতো। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় শৈশবে বাবাকে যেমন হারিয়েছি, তেমনি নিজেও একাধিকবার দুর্ঘটনায় পড়েছি। রাস্তায় বেরোলে হেঁটেই যাই বা যানবাহনে চলি, প্রাণপাখি থাকে হাতের মুঠোয়। কখন উড়াল দেয়, এই ভয়ে জড়সড় থাকি।

সংসারে যে একলা মানুষ, সে মরলে ভাগফল—নিঃশেষে বিভাজ্য। কিন্তু যার আয়ে বা অভিভাবকত্বের ওপর একটি পরিবার নির্ভরশীল, সে মরলে সংসারে শনি লাগে। অবিশিষ্ট সদস্যদের পড়তে হয় অকুলপাথারে। জগদ্দল পাথর বলতে দুর্বহ যে একটা বোঝা আছে, চলতে–ফিরতে হাড়ে হাড়ে টের পায় তারা। যা টের পেতে পেতে বড় হয়েছি। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে, সেই ঘরের মানুষদের দুঃখব্যথা মর্মে মর্মে অনুভব করি। মা বুক চাপড়াবেন, বাবা হাহাকার করবেন, ভাইবোন চোখের জলে বুক ভাসাবেন, স্ত্রী–সন্তান অথই সাগরে পড়ে কেবলই খাবি খাবে। কিন্তু স্বজন হারানো এ ব্যথা শেষ হবে না। শোকের অনির্বাণ শিখা জ্বলবে সারা জীবন। ঢাকার বাইরে যেসব মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বজনেরা মিলে কোনো বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন বা বিদেশফেরত কোনো আত্মীয়কে বিমানবন্দর থেকে আনতে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার প্রাণহানি হরিষে বিষাদ বয়ে আনে। যেমন আজকের হবিগঞ্জের দুর্ঘটনাটি। নবীগঞ্জ উপজেলায় যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস মহাসড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ায় নয়জন মারা গেছেন। আহত চারজন। আজ সকাল সাতটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। কাতারপ্রবাসী এক যুবক স্বজনদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে কনে দেখতে যাচ্ছিলেন। পথে কী মর্মান্তিক ঘটনা! এ ধাক্কা সামলানোর আগেই একে একে আসতে থাকে আরও সড়ক দুর্ঘটনা, আরও প্রাণহানির খবর। ময়মনসিংহ, ঢাকার সাভার, ফেনী, কুমিল্লার দাউদকান্দির সড়ক দুর্ঘটনা মিলিয়ে ১২ ঘণ্টায় প্রাণহানির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২২–এ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া এই মাইক্রোবাস। বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৬ মার্চ। ছবি: বদর উদ্দিন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া এই মাইক্রোবাস। বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৬ মার্চ। ছবি: বদর উদ্দিন

শরীরের একই জায়গায় একের পর এক আঘাত খেলে সে জায়গা একসময় অবশ হয়ে যায়, অনুভূতি কাজ করে না। মনে হচ্ছে যেন তেমনই এক বোধহীন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সারা বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছে। কিন্তু আজ এই এক বেলার মধ্যে বিভিন্ন জেলার সড়কে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটল, এর বিভীষিক কম কিসে? বললে খারাপ শোনাবে, কিন্তু এটা তো সত্য যে সড়কে আজ মড়ক লেগেছে! করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তবু চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে, আগে থেকে সাবধান হওয়া যায়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু তো আচমকা ঘাড়ে খড়গ চালানোর মতো—এই আছি এই নেই!

আর এই দুর্ঘটনা ও মুত্যুর মিছিল থামার কোনো লক্ষণ নেই। বরং বেড়েই চলেছে। গত ৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘২০১৯ সালে ৪৭০২ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৫২২৭ জনের’। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের তথ্যের বরাতে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় ৬ হাজার ৯৫৩ জন। সবচেয়ে বেশি ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। এর প্রমাণ তো আজই রয়েছে। ফেনী আর সাভারে চারজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস আর মাইক্রো ছাড়াও মোটারসাইকেল ও ট্রাক ছিল। ছিল পিকআপ। এখানে দোষ কার বা কাদের? এসব যানের চালকদের? হ্যাঁ, তাঁদের দোষ দিতে গেলে বলতে পারেন, দুর্ঘটনাকবলিত যানগুলোর চালকেরা ছিলেন বেপরোয়া। বলতে পারেন, তাঁরা ছিলেন অনভিজ্ঞ, আনাড়ি। গাড়িরও দোষ দেওয়া যায়। গাড়ির কলকবজা ঠিক ছিল না। ইঞ্জিনে গোলমাল ছিল, ব্রেকে সমস্যা ছিল।

এভাবে বলতে গেলে অপর পক্ষ আবার বলবে যে চালক বা গাড়ির দোষ দিয়ে কী হবে? যাত্রী বা আরোহীদের তাড়া ছিল। তাঁদের চাপেই বেপরোয়া হয়েছেন চালক। কেউ কেউ সড়কের দোষও দিতে পারেন। এখানে খানাখন্দ, ওখানে ভাঙা ইত্যাদি। কিন্তু দোষাদোষি আর সমালোচনা—বিতর্কে কী হবে? রাত–দিন মুখে তুফান ছুটিয়ে গেলেও বাদানুবাদ থামবে না। তবু সড়কে চলার ক্ষেত্রে একটুখানি সচেতনতাবোধ কারও মনে জাগবে না। চালক যেমন ওভারটেক করার প্রবণতা বা রাস্তা বুঝে গতি নিয়ন্ত্রণ করার গুরুত্ব বুঝবেন না, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলে যাবেন, তেমনি যাত্রী বা আরোহীরা অনেকে অনুধাবন করবেন না সময়ের চেয়ে জীবনের দাম অনেক বেশি—তাই তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কেবল একটুখানি সচেতনাবোধ আর সাবধানতা আমাদের গুরুতর পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশেষ করে চালকদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, একটা স্টিয়ারিং হুইল কেবল তাঁর খেয়ালখুশির চরকা নয়, একসঙ্গে অনেক মানুষের জীবন এতে বাঁধা। তাঁর একটুখানি ভুলের ফলে অনেক বড় বিপদ ঘটতে পারে।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও লেখক
[email protected]