সড়কে ধাক্কাটা আমি খেলে কী হতো

আমার ড্রাইভার শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু তাকে কেউ ভুলভাবে টেক-ওভার করলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে ‘হুৎ’ করে একটা শব্দ করে আচমকা গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। আমি হাত–পা ছুড়ে চিৎকার করে থামাতাম তাকে। তারপরও কখনো তার ভুলে, কখনো অন্য গাড়ির ভুলে প্রতি দু–তিন বছরে অন্তত একবার ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ভাগ্য ভালো এগুলো কোনো মারদাঙ্গা সাংসদ বা নেতার গাড়ির সঙ্গে হয়নি। হলে কী অবস্থা হতো, হাজি সেলিমপুত্র ইরফান সেলিমের কাণ্ডের পর ভেবে শিউরে উঠেছি।

এমন কারও গাড়ির সঙ্গে টোকা লাগামাত্র নিশ্চয়ই আমাকে গাড়ি থামাতে হতো। নেমে পরিচয় দেওয়ামাত্র অন্য পক্ষ গালাগালির বন্যা বইয়ে দিত। আমি প্রতিবাদ করলে নাকে–মুখে ঘুষি খেতাম। নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মতো আত্মরক্ষার কৌশল জানি না বলে মার খেয়ে আমার অবস্থা হতো শোচনীয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতাম ক্ষুণ্ন মনে। পরে হয়তো থানায়ও যেতাম। গেলে দেখতাম মামলা নিতে আগ্রহী নয় থানা। কিংবা দেখতাম উল্টো আমার নামে মামলা হয়েছে, থানায় গাড়িও আটকে রাখা হয়েছে শুধু আমারটা।

ভোগান্তি এখানে শেষ হতো না। পরদিন পত্রিকায় দেখতাম সেই নেতার জনসংযোগ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, আমিই উল্টো মারতে গিয়েছিলাম তাদের। তারা আত্মরক্ষা করতে গিয়েছিল এবং নিজে নিজে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার দাঁত ভেঙে গিয়েছিল।

আমি তবু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার চেয়েও অনেক অসহায় জীবন যাপন করে এ দেশের বহু মানুষ। তাদের কেউ নেতা–এমপির গাড়িতে ধাক্কা খেলে অবস্থা হতো আরও শোচনীয়। গাড়ির ধাক্কা দূরের কথা, স্রেফ রাস্তায় যানজটে ক্ষিপ্ত হয়ে হোমরাচোমরা গুলি করেছে, কিংবা খোশমেজাজে রাজপথে গাড়ি চালানো প্র্যাকটিস করতে গিয়ে মানুষ মেরেছে—এমন সংবাদও পত্রিকায় পড়েছি আমরা। সেগুলোর অধিকাংশের বিচার হয়নি, তবে মানুষের জান চলে গেছে বলে পত্রিকায় খবর হয়েছে। কিন্তু আমজনতা কিল-ঘুষি বা গালাগাল খেলে তা খবর পদবাচ্য হিসেবেই বিবেচিত হতো কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

এমন একটা দেশে নৌবাহিনীর কর্মকর্তার ওপর হাজি সেলিমের পুত্রের চড়াও হওয়ার পর যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা খুব ব্যতিক্রমী ঘটনা। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে র‌্যাব সেখানে তল্লাশি করেছে, ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট ইরফান সেলিমকে (এবং তাঁর সঙ্গী–সহযোগীদের) দেড় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া যে মামলায় শাস্তি দেওয়া যায় দ্রুত এবং তুলনামূলক অনায়াসে সে অস্ত্র মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, মারধর আর হত্যাপ্রচেষ্টার জন্যও মামলা হয়েছে। ইরফান সেলিমের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে এবং তঁাকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

২.

সো ফার, সো গুড! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি সমাজে ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের উদাহরণ? নাকি শুধু সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ? ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থা কি তিনি এসব অপরাধ করেছেন বলে নেওয়া হচ্ছে, নাকি অপরাধটা নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়েছে বলেই নেওয়া হচ্ছে?

আমার মনে হয়, এ দেশে এমন কেউ নেই এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না। হাজি সেলিম, তাঁর পরিবার ও ক্যাডার বাহিনীর অপকর্মের অজস্র খবর গত ১০–১৫ বছরে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের থেকে শুরু করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও সরকারি ব্যাংকের গুদাম দখল করার প্রামাণ্য সংবাদ পত্রিকায় এসেছে। খুন, খুনের চেষ্টা, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের কারণে বহু মামলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু কখনো তাঁকে কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। এমনকি আগে কখনো এত অভিযোগের পরও তাঁর বাড়ি বা অফিসে কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। জানা যায়নি সেখানে কত বছর ধরে আছে মাদক, অবৈধ অস্ত্র, ওয়াকিটকি, হাতকড়া আর টর্চার সেল!

হাজি সেলিমের তুলনায় তাঁর পুত্রের আমলনামা নগণ্য। তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে এখন যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেটি কেবল একজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা তাঁর ভিকটিম হয়েছে বলে—এটি তাই ভাবার কারণ আছে। সেটিও সম্ভবত নেওয়া হতো না, ঘটনাটি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ভিডিও করে না রাখলে এবং পত্রিকায় তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রকাশিত না হলে।

আমাদের মনে আছে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের পর এর বিচার দূরের কথা বরং সিনহা ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে উল্টো মিথ্যা মামলা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কয়েক দিন আগে সিলেটে রায়হান নামের এক নিরীহ যুবক পুলিশের এসআই আকবরের পাশবিক নির্যাতনে নিহত হন খোদ থানাহাজতে। ভাইরাল হওয়া এসব ঘটনায় প্রথমটায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মাত্র গ্রেপ্তার হয়েছে, দ্বিতীয়টায় অকাট্য মামলা হওয়ার পরও অভিযুক্ত পুলিশকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

এসব ঘটনা আমাদের এই বার্তা দেয় যে এ সমাজে সাধারণ মানুষের জন্য আইনের শাসন নেই। এ দেশে শক্তি আর ক্ষমতায় যারা এগিয়ে, যেমন পুলিশ, সরকারি দলের নেতা (এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা), প্রশাসনের মানুষ, সশস্ত্র বাহিনী—তারা কোনো ঘটনায় ভিকটিম হলে, তাদের আন্তসম্পর্কে কোনো অপরাধ ঘটলে তার বিচার হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাদের কেউ যত বড় অপরাধ করুক না কেন, এর বিচার হয় না সাধারণত এ দেশে।

৩.

ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট বহু বছর ধরে বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। আগের কয়েক বছরের মতো এ বছরও তাদের র‌্যাঙ্কিংয়ে আইনের শাসনে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে (১২৮ দেশের মধ্যে ১১৫)। সিভিল আর ক্রিমিনাল জাস্টিস মানদণ্ডে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান ছয়টি দেশের মধ্যে পঞ্চম। এসব র‌্যাঙ্কিং সব সময় নিখুঁত হয় না, এর পেছনেও থাকে নানা হিসাব–নিকাশ। এসব র‌্যাঙ্কিং জানার অবশ্য প্রয়োজনও নেই আমাদের। আমরা তো আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানি কী হচ্ছে এ দেশে এখন। ইরফান সেলিম, সম্রাট, পাপিয়াসহ আরও কিছু ঘটনায় আমরা দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাড়িতে বা অফিসে মাফিয়া ডনের মতো নির্যাতনকেন্দ্র, অবৈধ অস্ত্র, মাদক, ওয়াকিটকি আর হাতকড়া। আরও ক্ষমতাশালীদের এলাকায় (যেমন ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী) তাঁদের নিজস্ব বাহিনীগুলোর প্রকাশ্য তাণ্ডব।

মানুষকে সেবা করার পদ (সাংসদ, মেয়র, কাউন্সিলর) এঁরা কেড়ে নিয়েছেন মানুষের ভোট ছাড়া। সেবা করার পদকে ব্যবহার করেছেন অত্যাচার ও লুট করার হাতিয়ার হিসেবে। হঠাৎ কখনো বেজায়গায় হাত দিলে, পত্রপত্রিকায় শোরগোল উঠলে একটু–আধটু বিড়ম্বনা হয় তঁাদের। কিন্তু এটা জাস্টিস নয়, এমনকি সিলেকটিভ জাস্টিসও নয়। এটা ক্ষমতা আর ক্ষমতাশালীদের আন্তসম্পর্ক অক্ষুণ্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার একটা চেষ্টামাত্র। সমস্যা হচ্ছে এই ক্ষমতা সম্পর্ক বা পাওয়ার রিলেশন মানুষের কল্যাণের জন্য নয়, মানুষের ওপর জুলুমকে হুমকিমুক্ত রাখার জন্য।

৪.

নিজের কথায় ফিরে যাই। রাস্তায় অশালীন সাইজের কিংবা উৎকট সাইরেন বাজানো গাড়ি দেখলে আমার ড্রাইভারকে গাড়ি এক পাশে সরিয়ে নিতে বলি। রিকশা বা সিএনজিতে থাকলেও তাই বলি। ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও তাদের স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি চালাতে দেওয়ার সাহস আমি পাব না।

আমার ধারণা, একই অবস্থা এ দেশের বহু মানুষের।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক