হকিংয়ের দেখা পেলাম

আরশাদ মোমেন
আরশাদ মোমেন

চলে গেলেন স্টিফেন হকিং। কোনো অপরিণত বয়সে নয়, জীবনের ৭৬ বছর পূরণ করেই তিনি এই ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন। দুই দিন আগেই নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় যে ৫১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ-এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। সেভাবে চিন্তা করলে হকিংয়ের প্রস্থানটা আর দশজন পরিণত মানুষের চলে যাওয়ার মতোই। যদি তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করি, তবে দেখা যাবে স্নায়বিক বৈকল্যে তাঁর স্বল্প আয়ু সম্পর্কে চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণ করে তিনি অনেক দিনই বেঁচে ছিলেন। কিন্তু হকিং সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল তাঁকে তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড থেকেও আরও অনেক বেশি উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। 

ব্যক্তিগতভাবে হকিংকে সামনাসামনি দেখার আমার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯১ সালে, যখন আমি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্রের ডিপ্লোমার প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ইতালির ত্রিয়েস্তের এই কেন্দ্রের পাশেই দেশটির আরেকটি গবেষণাকেন্দ্র, যাকে ইতালীয় ভাষায় আদ্যাক্ষরগুলো মিলিয়ে সিসা বলে অভিহিত করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত ছিলেন স্টিফেন হকিংয়ের পিএইচডির সুপারভাইজার ডেনিস সিয়ামা। তাঁর ৬৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল এক সম্মেলনের। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন সিয়ামার ছাত্র হকিং, সিয়ামার সহযোগী রজার পেনরোজ এবং আরও অনেকে। কিন্তু যাঁরা অপেক্ষাকৃত তরুণ, তাঁদের সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন হকিংকে দেখার জন্য। হকিংয়ের জন্য এ সময়টা ছিল একটু অস্বস্তিকর; কারণ, তিনি তখন তাঁর প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইল্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যাঁরা হকিংকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র দ্য থিওরি অব এভরিথিং দেখেছেন, তাঁরা এই বিজ্ঞানীর জীবনে তাঁর এই স্ত্রীর অবদান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখবেন। এ কারণে আমরা লক্ষ করেছিলাম, ওই সম্মেলনে হকিংয়ের অনেক বন্ধুই তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন না। এতে অবশ্য আমার মতো ছাত্রদের একটা সুবিধা হয়েছিল। আমরা তাঁকে ধরে বেশ কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার সহকর্মী অধ্যাপক কামরুল হাসান বেশ কয়েকটা ছবি হকিংয়ের সঙ্গে তুলেছিলেন। এখনকার মতো ওই সময়ে সেলফি আর ফেসবুকের চল থাকলে আমিও ওই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতাম। সে সময় কী প্রশ্ন করেছিলাম আর তিনি কী উত্তর দিয়েছিলেন, তা এখন মনে নেই। তবে এ ঘটনা আমার সব সময় মনে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি খুব কমই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হকিং একজন ব্যতিক্রম। একবার মিলানের রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। সঙ্গে কোনো বইও নিইনি যে বসে পড়ব। ইতালীয় ভাষার বই পড়তেও পারি না। দোকানে গিয়ে একমাত্র যে ইংরেজি বইটা পেলাম, সেটা আর কিছু নয়-আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম। বলতে দ্বিধা নেই, জীবনানন্দ দাশকে বনলতা সেন যে রকম ‘শান্তি’ দিয়েছিলেন, আমিও সেই দীর্ঘ পরিভ্রমণের সময় এই বই পড়ে শান্তি পেয়েছিলাম। বইটা পুরো যাত্রার সময় একবারও বন্ধ করিনি।
এখন আমার মনে এ মুহূর্তে যে প্রশ্নটি আসছে, সেটা হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হকিংকে শুধু একজন হুইলচেয়ারে আবদ্ধ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে মনে রাখবে, যিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানকে একই খাঁচায় বন্দী করেছিলেন, নাকি যিনি সাধারণ মানুষকে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শেখালেন। আমি বলব-দুটোই। আমাদের তরুণেরা হকিংয়ের কাজের গভীরে ঢুকে নতুন নতুন ধারণা নিজেরা তৈরি করুক-এটাই আমার কাম্য।

আরশাদ মোমেন 
অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়