হঠাৎ অভিযানের চেয়ে নিয়মিত নজরদারিই বেশি জরুরি

গত তিন দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটি কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল ১৯৮৫ সাল থেকে। এর আগের চিত্রের দিকে তাকালে একধরনের অস্বস্তি হবে। উন্নত চিকিৎসা এ দেশে প্রায় বিরল ছিল। স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষকে কম ভুগতে হয়নি।

রোগ নির্ণয়ে নতুন যুগ

আশির দশক থেকে দেশে একে একে ইবনে সিনা, ল্যাবএইড, পপুলার, মেডিনোভা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতি, মানসম্মত পরিবেশ, দক্ষ প্যাথলজিস্ট দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ঘুরে দাঁড়াতে থাকে স্বাস্থ্য খাত। মানুষের ভোগান্তি কমে আসে।

তারপর উন্নত প্যাথলজি ল্যাব, অটোমেশন, উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, সার্বক্ষণিক প্যাথলজিস্ট, টেকনোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, এমএসসি সম্পন্ন করা সায়েন্টিফিক অফিসার, উন্নত সিটিস্ক্যান মেশিন, এমআরআই, পিসিআর ল্যাবে সমৃদ্ধ হয় স্বাস্থ্যসেবা খাতে তৈরি রোগনির্ণয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো। আজ ২০২০ সালে এসে আমরা দেখছি রোগনির্ণয়ে কিংবা ফলোআপের জন্য বিদেশের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না।

পূর্ব পরিস্থিতি

কয়েক দশক আগে প্যাথলজি ল্যাবরেটরি বলতে ছিল একটি কক্ষ। উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনবল সংকটে দীর্ঘ সময় ধরে নমুনা জমে থাকত। সেটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা কিংবা সঠিক নিয়মে সংগ্রহ হতো কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন ছিল। অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতালের অধ্যাপকদের সিল, সিগনেচার করা কাগজে মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে দিত। সত্যিকারের ভরসা বলতে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ। বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সেটি ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল।

আশির দশকের হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসা বলতে নরমাল ডেলিভারি আর বড়জোর অ্যাপেনডিসেকটমির মতো সাধারণ চিকিৎসা পেত মানুষ। অন্যান্য অপারেশনের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি) হাসপাতালে মাসের পর মাস লাইন দিয়ে থাকতে হতো। আর একটা কেবিন পাওয়া ছিল মিলিয়ন ডলারের লটারি জেতার মতো। আজ ২০২০ সালে এসে এগুলো হয়তো দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু এটাই ছিল তখনকার সময়ের স্বাভাবিক চিত্র। আর এখন হৃৎপিণ্ডের জটিলতম সার্জারি, মস্তিষ্কের নিউরোনেভিগেশন, টেস্টটিউব বেবি, কিডনি-লিভার প্রতিস্থাপন, কী হচ্ছে না দেশে!

স্বাস্থ্য খাতের সুযোগসন্ধানী

পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সম্প্রতি সবাই জেনেছে, জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের সীমাহীন অনিয়মের কথা। কিছু প্রতিষ্ঠান কোভিড–১৯ টেস্ট না করে রিপোর্ট দিয়ে দিচ্ছে। নামে হাসপাতাল কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, প্রয়োজনীয় জনবল নেই। ভুয়া বিল হচ্ছে, ভুয়া ডাক্তার বসছে চেম্বারে।

গুলশানের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনিবন্ধিত অ্যান্টিবডি টেস্ট করে আরটি পিসিআর কোভিড–১৯ রিপোর্ট দিয়ে দেওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। এগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক। লাইসেন্সবিহীন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর খবরগুলোও আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। পরিচিত ফার্মেসিতেও মেয়াদোত্তীর্ণ, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ওষুধে ভরে গেছে। পুলিশ, র‍্যাব বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে এ অনিয়মগুলো ধরাও পড়ছে। যাঁরা এ অনিয়মগুলো খুঁজে বের করেছেন, তাঁদের জন্য ধন্যবাদ এবং একই সঙ্গে বলব, এ অভিযান নিয়মের মধ্যে থেকে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।

অভিযান ও নজরদারি

অভিযান পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না মানা হলে, সতর্ক না হলে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর নামও খারাপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উঠে আসতে পারে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার অভাব যেন না হয় এবং বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা যেন বেড়ে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশে বর্তমানে একটি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর জন্য ফার্মেসি ড্রাগ লাইসেন্স, নারকোটিক লাইসেন্স, ব্লাড ব্যাংক, বিএসটিআই, ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, অ্যাটমিক এনার্জি লাইসেন্স, পরিবেশ লাইসেন্সসহ প্রায় ১৬টি লাইসেন্স অথরিটি আছে। যারা নিয়মনীতি মানতে চাইবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নৈতিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অধিকারও তাদের নেই। তবে ডিজি হেলথ যেহেতু প্রধান সমন্বয়কারী, তাই ডিজি হেলথের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের উপস্থিতিতে একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মগুলো চিহ্নিত করে শুদ্ধ হওয়ার সময় বেঁধে দিতে পারে এবং তারপর সেবা বন্ধ করে দিতে পারে। এবার কোভিড–১৯ সংক্রমণ প্রমাণ করে দিয়ে গেল, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সংকটময় মুহূর্তে আপনি যত ধনী কিংবা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, দেশের চিকিৎসা পরিষেবার ওপরেই আপনাকে ভরসা করতে হবে।

দেশের মানুষ দুই–তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে অ্যাক্রেডিটেশন ব্যবস্থাও আছে। প্যাথলজি ল্যাবের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বিএবি’ সার্টিফিকেশন দেওয়া হয়। হাসপাতালের জন্যও ‘বিএবি ফর হসপিটাল’ দেওয়া যেতে পারে। ভারতে এখন ল্যাবের জন্য ‘এনএবিএল’ এবং হাসপাতালের জন্য ‘এনএবিএইচ’ অ্যাক্রেডিটেশন বাধ্যতামূলক। প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করার দুই বছরের মধ্যে সব শর্ত পূরণ করে এ সার্টিফিকেট নিতে হয় এবং প্রতি দুই বছর পরপর অডিট করে নবায়ন করাতে হয়। এতে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ন্ত্রিত থাকে। পাশাপাশি ১, ২, ৩ গ্রেডিং থাকলে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরও ভালো সেবা প্রদানের একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকবে। শুধু হঠাৎ করে অভিযান নয়, বরং নিয়মিত নজরদারি বাড়াতে হবে।

জনস্বাস্থ্যে জনবান্ধব প্রকল্প

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য হেলথ ইনস্যুরেন্স করা উচিত। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া গেলে সাধারণ জনগণ এর সরাসরি সুবিধা ভোগ করবে। ভারতে পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপে ‘আরোগ্যশ্রী’ নামে একটি প্রকল্প আছে। এটি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। এ প্রকল্পে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালের ২৫ শতাংশ সেবা স্বল্প খরচে রোগীদের দেওয়া হয়, যার খরচ সরকার বহন করে। এতে দেখা যাচ্ছে ভারতের ৬০-৭০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনগোষ্ঠী বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এসেছে।

সবশেষে বলতে চাই, শুধু সমালোচনা এবং দোষারোপ না করে সবার সহযোগিতার মাধ্যমে গত ৩০ বছরে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করে উন্নত মানের সেবার নিশ্চয়তাই সবার কাম্য। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা নয়, বরং আস্থাবান করে তোলাই আমাদের সবার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই হোক সুস্থ থাকার উপায়।

ডা. এ এম শামীম: ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক