হঠাৎ হুদা কমিশনের বিবেক জাগ্রত হইল...


‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’
কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনও চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনের ফল বাতিল করে প্রমাণ করেছে, নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি। সেখানে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার আছে কোথাও নির্বাচনে অনিয়ম হলে তার ফলাফল বাতিল করার। কিন্তু অতীতে কখনো তারা সে ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। বরং নির্বাচনে অনিয়ম–কারচুপির অভিযোগ এলেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা জোর গলায় প্রতিবাদ করেছেন। কখনো বলেছেন, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। এমনও বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিতে পারে।
চরভদ্রাসনের উপনির্বাচন নিয়ে হঠাৎ নির্বাচন কমিশনের বিবেক জাগ্রত হলো কেন? কারচুপির অভিযোগকে তারা কেন অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে দুই মাসেরও কম সময়ের তদন্তকাজ শেষ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, ‘অনিয়মের কারণে নির্বাচনের ফল বাতিল করা হলো।’ প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বহুল আলোচিত ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অনিয়মের অভিযোগে এই নির্বাচন বাতিল করে গত রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি।

গত ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ হয়। ওই নির্বাচন বাতিল করে জারি করা ইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপনির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল ইসি। কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিয়েছে। তদন্তে নির্বাচন পরিচালনায় অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালার ৮৮ বিধি অনুসারে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন।
ওই উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন কাউছার হোসেন। ভোটের ১৫ দিন আগে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফরউল্যাহর পক্ষ ছেড়ে স্থানীয় স্বতন্ত্র সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর পক্ষে যোগ দেন। ফলে, নিক্সনের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে কাউছার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিজয়ী হন।
সাম্প্রতিক কালে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন মিলে যে ধরনের নির্বাচন করে, চরভদ্রাসন তার ব্যতিক্রম ছিল না। ব্যতিক্রম হলো সেখানে স্থানীয় সাংসদ তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরোধ। অন্যান্য নির্বাচনে দেখা গেছ, যত কারচুপি ও জালিয়াতি হোক না কেন, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল মিলেমিশে করেছে। এখানে মিলমিশ হয়নি বলেই নির্বাচনটি বাতিল হলো!

২০০১ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের অনেকে এখনো প্রশাসনে আছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে কেন তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করলেন?

সাংসদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) টেলিফোন করে কী কী বলেছেন, তা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। বিষয়টি জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মর্মাহত করে এবং তাঁরা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিকার চান। বিসিএস প্রশাসন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে সাংসদের এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদ করেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তাঁদের এই প্রতিবাদ ও নালিশ নির্বাচন কমিশন ত্বরিত আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে, যার ভিত্তিতে চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাচন বাতিল ঘোষিত হয়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যখন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন হেলালুদ্দীন আহমেদ নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। ওই নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কোথায় কত শতাংশ ভোট পড়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে কত শতাংশ ভোট প্রদানের কথা প্রচার করা হয়েছে, তা দেশের মানুষ দেখেছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এসব অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা প্রকাশ না পেলেও বিবিসিসহ কোনো কোনো বিদেশি গণমাধ্যম সরেজমিন রিপোর্টে কিছু কিছু ফাঁস করে দিয়েছে। টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) অন্তত ৫০টি আসনের যে চালচিত্র প্রকাশ করেছে, তা দেশের জন্যও লজ্জাজনক। বিরোধী দলের প্রার্থীরা যখন নির্বাচনের ব্যাপক অনিয়ম–কারচুপির অভিযোগ এনে তা বাতিল করার দাবি করলেন, নির্বাচন কমিশন বলল, তথ্য–প্রমাণ দিন। অনেকে তথ্যপ্রমাণ জমাও দিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে নির্বাচন কমিশন কালা ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে।

চরভদ্রাসনের নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন এবং প্রতিকার চেয়েছেন। এ জন্য তাদের তারিফ করি। কিন্তু ২০১৮ নির্বাচনে যে এর চেয়েও গুরুতর অন্যায় ও অবিচার হলো, তখন তাঁরা নিশ্চুপ থাকলেন কেন? প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরা আইনানুযায়ী অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। কে কোন দলের প্রার্থী, তা দেখা তাঁদের দায়িত্ব নয়। ২০০১ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের অনেকে এখনো প্রশাসনে আছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে কেন তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করলেন?
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে চরভদ্রাসনের মানুষ নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত পেয়েছে। সেখানে যদি স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরোধ না হতো, তাহলে অনিয়মের নির্বাচনই জায়েজ হয়ে যেত।
নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগে চরভদ্রাসনের উপনির্বাচন বাতিল করেছে। খুব ভালো কথা। নিকট অতীতে চরভদ্রাসনের চেয়েও গুরুতর অনিয়ম হয়েছে, সেসব নির্বাচন সম্পর্কে কেন তারা নিশ্চুপ? নির্বাচন কমিশনের কাছে হাজার হাজার অভিযোগ আছে, যার তদন্ত হয়নি। তদন্ত হলেও তারা চরভদ্রাসনের মতো ন্যায্য ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই কমিশনে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই দলীয় কর্মচারী হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। এ রকম নতজানু নির্বাচন কমিশন দিয়ে আর যা–ই হোক, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায় না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।