হত্যাকারী নয়, হতাহতদের দিকে তাকাই

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা। ফাইল ছবি
নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা। ফাইল ছবি

আমি এখনো সেই সন্ত্রাসীর নাম জানি না। আমি তা জানতেও চাই না। শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর ভয়ের পাশাপাশি আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। উদ্বেগের সঙ্গে মিশেছিল ঘৃণা। আমি ঘটনাটি শোনার কয়েক মিনিট পর বের হয়ে যাই এটা জানার জন্য যে কেন এই হত্যাকাণ্ড চালানো হলো।

কিন্তু এরপর আমি থেমে যাই। আমি এটা উপলব্ধি করলাম যে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত সংবাদের শিরোনামগুলো আমাকে এটা করার জন্য প্রলুব্ধ করছে। আমি এখন ঝাঁপিয়ে ওই সন্ত্রাসীর কথা শুনব। তাঁর নাম জানব, তাঁর ছবি তুলব, হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সংগ্রহ করব।

মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে হামলাকারীর ছবি ও নাম ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছিল। আমার দৃষ্টি ও মনোযোগ আপনা–আপনি নিবদ্ধ হচ্ছিল তাঁর ছবির দিকে ও হত্যাকাণ্ডের ভিডিওর দিকে। অথচ হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের ছবি বা তাঁদের পরিচয় কোনোটিই প্রচার করা হচ্ছিল না। তাঁদের মোট সংখ্যা ৫০।

যখন গণমাধ্যমে ওই সন্ত্রাসীর কথা পূর্ণোদ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ করার ব্যাপারে তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ডাইলান রুফ ও আন্দ্রেস ব্রেইভিকের মতো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা বলা হচ্ছে; তখন আমি মুসলিম হতাহতদের প্রতি মনোযোগ দিই, তাঁদের নাম, তাঁদের জীবনের গল্প জানার চেষ্টা করি।

আমি যদি এখন এটা না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আর তা করবে না। সাধারণত দেখা যায়, মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে মুসলমানরা তখনই খবরের শিরোনামে আসে, যখন তারা থাকে হামলাকারীর ভূমিকায়। হামলার শিকার হলে তারা আর খবরে আসে না। ইসলামভীতি বা ইসলামকে ঘৃণা করার কারণে মুসলমানরা থাকে নামহীন, চেহারাহীন।

ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের প্রোফাইল সম্প্রচার করে আমি একই সঙ্গে গণমাধ্যমের সেই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করছিলাম এবং ওই সন্ত্রাসীকে হাইলাইট করার বিষয়টি উপেক্ষা করছিলাম।

আমি তিন বছর বয়সী মুসা ইব্রাহিমের কথা তুলে ধরছিলাম, যে কিনা নিহত ৫০ জন ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সেও এসেছিল মসজিদে নামাজ পড়তে। কিন্তু ঘাতকের গুলি তার প্রাণ কেড়ে নেয়। সোমালীয় শরণার্থী এই শিশুর পরিবার ভুলভাবে ভেবেছিল যে নিউজিল্যান্ড সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

শিশু মুসার কাছেই পড়ে ছিলেন দাউদ নবি, হামলায় নিহতদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি। সন্ত্রাসীর গুলিতে ৭১ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ প্রথম মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আরেকজন মুসল্লির জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি লাফ দিয়ে সন্ত্রাসীর সামনে দাঁড়ান। তাৎক্ষণিকভাবে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর বুক। তিনি নিজের দেশ আফগানিস্তানের যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু নিহত হলেন এমন একটি গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং ইসলামের প্রতি ঘৃণা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ওই দিনের হামলার ঘটনায় নবিই একমাত্র বীর নন। নাইম রশিদ নামের আরেকজন মুসল্লি খালি হাতে সন্ত্রাসীকে প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন। ঘাতকের নির্মম বুলেট তাঁর বুকও ঝাঁঝরা করে দেয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি হত্যাকারীর বন্দুকের নলকে অন্যদের দিক থেকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ফলে বেঁচে যায় অনেকের প্রাণ। কিন্তু এই হামলায় তাঁর ২০ বছর বয়সী সন্তান তালহা ও আরেক সন্তান আবদুল্লাহি ডাইরিও নিহত হন।

এগুলো মাত্র অল্প কয়েকজনের গল্প। নিহতদের আরও অনেকের অনেক রকম গল্প আছে। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর কাছে এঁরা এখন কেবলই সংখ্যা। ৫০ সংখ্যাটি তাঁদের জীবনের গল্প বলতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের প্রিয়জনদের দুঃখ–বেদনা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের ব্যাধিগ্রস্ত বা রুগ্ণ হয়ে পড়া সাংবাদিকতায় মনোযোগ দেওয়া হয় সন্ত্রাসীর দিকে এবং বিশেষ করে সেই সন্ত্রাসী যদি হন কোনো শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। আমরা তাঁদের প্রতিটি শব্দ শুনতে যাই। তাঁদের উদ্দেশ্য, তাঁদের শৈশবের কথা এবং তাঁদের আদর্শগত প্রেরণার কথা জানতে চাই। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো আমাদের এমনটাই করতে শিখিয়েছে। ফলে আমরা খলনায়কের প্রতি মনোযোগী হই এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে দূরে থাকি।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা যদি এভাবে হামলা চালিয়ে গণমাধ্যমে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা প্রচার করতে চান, তাহলে তাঁকে বাধা দিতে হবে। আমাদের অবশ্যই সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসীর ছবি, তাঁর আদর্শের কথা ইত্যাদি শেয়ার করা বা রিটুইট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের মনোযোগ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দিকে নিবদ্ধ করা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই হচ্ছে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

খালেদ এ বেদুন: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ডেট্রয়েট মার্সি স্কুল অব ল–এর আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক