হাওয়া এখন কংগ্রেস-বাম জোটের দিকে

মমতার ​তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম ও কংগ্রেস জোরদার লড়াই চালাবে বিধানসভা নির্বাচনে
মমতার ​তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম ও কংগ্রেস জোরদার লড়াই চালাবে বিধানসভা নির্বাচনে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ছয় পর্বের (সাত দিন) নির্বাচনের মধ্যে মাত্র তিন পর্বের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের পাল থেকে একটু একটু করে ভোটের হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে কংগ্রেস-বাম জোটের দিকে।
৪ এপ্রিল জঙ্গলমহল দিয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ পর্ব শুরু হয়, তখন পরিস্থিতি ছিল ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে। রাজ্য পুলিশ সক্রিয়ভাবে সাহায্য করছিল, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চুপ হয়ে ছিল, নির্বাচন কমিশনও বিরোধীদের অভিযোগে গুরুত্ব দিচ্ছিল না। ১১ এপ্রিল ভোট গ্রহণের দ্বিতীয় পর্বেও ছিল একই পরিস্থিতি। তার সুযোগে বহু জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজন বুথের পর বুথ দখল করে জাল ভোট দিতে পেরেছিল। এরপর চারদিক থেকে প্রবল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বাকি দুই সদস্যকে নিয়ে কলকাতায় ছুটে আসেন এবং সব পক্ষের মতামত শোনেন।
তারপরই কমিশন কিছু ব্যবস্থা নেয়। আর তার ফল দেখা যায় ১৭ এপ্রিল ভোট গ্রহণের সময়। কেন্দ্রীয় বাহিনী বহু জায়গায় আর দর্শকের ভূমিকায় থাকেনি, তারা বুথ দখলে বাধা দিয়েছে। তৃণমূলের গুন্ডাদের আক্রমণে একাধিক জওয়ান জখম হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাহিনী রাস্তায় নেমে বেশ কিছু জায়গায় বুথ দখল ঠেকিয়েছে। আর বিরোধীরাও নির্বাচন কমিশনের ওপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে সাধ্যমতো নিজেরাই প্রতিরোধ করেছে। সর্বত্র না পারলেও বীরভূমের অনেক জায়গায় তারা সফল।
বীরভূমে তৃণমূল কংগ্রেসের বাহুবলী নেতা অনুব্রত মণ্ডলের হুমকি উপেক্ষা করে যেভাবে বিরোধী কংগ্রেস-বাম জোট সফলভাবে প্রতিরোধ করেছে, সেই বার্তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাগুলোতে। এ পর্যন্ত তিন দিনে মোট ১০৫টি আসনে ভোট হয়েছে। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার (দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ) ৪৫টি আসনে ভোট হয়ে গেছে। একমাত্র কোচবিহার জেলার নয়টি আসনে ভোট গ্রহণ হবে নির্বাচনের শেষ দিন ৫ মে। উত্তরবঙ্গের সাত জেলার মোট ৫৪ এবং সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ জেলার ২২টি, মোট ৭৬টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ও বাম জোটের প্রভাবই বেশি। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সেখান থেকে হাতে গোনা কয়েকটির বেশি আসন জেতা সম্ভব হবে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই হিসাব জানেন। আগের নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস বেশি সফল হয় দক্ষিণবঙ্গ থেকেই। তাই মমতার নির্দেশ ছিল বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা ও নদীয়া থেকে যত বেশি সম্ভব আসন সংগ্রহ করতে হবে। দক্ষিণবঙ্গের এই নয় জেলার মোট আসন ১৭৭টি। এর মধ্যে বীরভূমের ১১টি ও বর্ধমানের চারটি আসনে ভোট হয়ে গেছে। এবং সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। আর তার ধাক্কায় এখন মমতাবিরোধী জোট পুরোপুরি উজ্জীবিত। কারণ, দক্ষিণবঙ্গের এসব জেলায়ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেই মমতার দ্বিতীয়বার সরকারে আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যে যে মমতার পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে শুরু করেছে, তার ইঙ্গিত দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই এসব জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে ছোট ছোট তৃণমূল নেতা অনুগামীদের নিয়ে কোথাও কংগ্রেস, কোথাও সিপিএমের মিছিলে এসে যোগ দিচ্ছেন। পূর্ব কলকাতার বস্তি এলাকায় রাতে তৃণমূলের বাহিনী শাসিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে চেষ্টা করেছিল। ২০১১ সালের পরে প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তৃণমূল এই সন্ত্রাস করে ভালো ফল পেয়েছে। মানুষ ভয়ে ভোট দিতে যায়নি, পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখও খোলেনি। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। তৃণমূলের সন্ত্রাস উপেক্ষা করে শত শত নারী রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। এই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কলকাতার বাইরেও হচ্ছে। তা থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে।
দক্ষিণবঙ্গে মমতাবিরোধী হাওয়া যে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে তার আরও প্রমাণ, নির্বাচনী প্রচারে মমতা এখন আর তাঁর সরকার গত পাঁচ বছর কী কী উন্নয়নের কাজ করেছে, সে বিষয়ে বেশি কথা বলছেন না। বরং তিনি বাধ্য হচ্ছেন তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি, সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, নারদ কেলেঙ্কারির ভিডিও টেপ ও কলকাতায় ভেঙে পড়া উড়াল পুল-সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে। আর সেটা করতে গিয়েই তিনি এখন বিভিন্ন সভায় বিভিন্ন কথা বলছেন। সর্বশেষ রোববার কলকাতায় নির্বাচনী জনসভায় মমতা বলে বসেছেন যে নারদ কেলেঙ্কারির ভিডিও টেপ যখন প্রকাশ পায়, তত দিনে নির্বাচনের প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা হয়ে গেছে, তাই তিনি নারদকাণ্ডে যাঁদের ঘুষ নিতে দেখা গেছে, প্রার্থীর তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দিতে পারেননি। মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি ও ফিরহাদ হাকিম, সাবেক মন্ত্রী ও সারদাকাণ্ডে কারাবন্দী মদন মিত্র, কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জি ও ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদকে ভিডিও টেপে ঘুষ নিতে দেখা গেছে, তবু তাঁরা এবারও তৃণমূলের প্রার্থী।

>২১, ২৫ ও ৩০ এপ্রিল কলকাতা ও তার চারপাশের জেলায় ভোট হবে। এর মধ্যে যদি মমতাবিরোধী হাওয়া আরও জোরালো হয়, তাহলে তা কিন্তু ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে

মমতা সময় পেরিয়ে যাওয়ার অজুহাত দিলেও তথ্য বলছে, ১৪ মার্চ নারদ ভিডিও টেপ প্রকাশের বেশ কদিন পরে এই প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন ছিল। মমতা চাইলেই এদের টিকিট না দিয়ে নতুন প্রার্থী দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি, বরং তখন তিনি ওই ভিডিও টেপকে মিথ্যা ও বিরোধীদের চক্রান্ত বলে খারিজ করেছিলেন। কিন্তু ভোটের হাওয়া ঘুরতে শুরু করায় এখন তিনি বুঝতে পারছেন, কলকাতাবাসী ও শহরাঞ্চলের ভোটদাতারা তাঁর কথায় আর ভুলছেন না। বরং আগে যাঁরা মমতার সব কথা বিনা বিচারে গ্রহণ করতে তৈরি ছিলেন, তাঁরা এখন ঘুরে যাচ্ছেন। ফলে মমতা এখন সুর পাল্টে বলছেন, ওই টেপে যাঁদের দেখা গেছে তাঁদের তিনি আগে জানলে টিকিট দিতেন না। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করছেন যে ওই নেতারা ঘুষ নিয়েছিলেন। মমতার এই সুর বদল ও ভোটদাতাদের কাছে আর্তি থেকেই স্পষ্ট, তিনি ভোটের গতি-প্রকৃতি দেখে যথেষ্ট বিচলিত। বিরোধীরা কটাক্ষ করছেন, মমতা এখন প্রাণপণে নিজের নির্বাচনকেন্দ্র দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর কেন্দ্রকে বাঁচাতে তাঁর সঙ্গী-সাথিদের বিসর্জন দিচ্ছেন।
বাস্তবিক এখন নির্বাচনী প্রচারে শাসক দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, শাসক দলের প্রশ্রয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসার নামে সমাজবিরোধীদের গুন্ডামির প্রসঙ্গই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। মমতার উন্নয়নের তালিকা, বাম আমলের যাবতীয় কুকীর্তি নিয়ে শাসক দলের এত দিনের প্রচার এখন চাপা পড়ে গেছে। তার বদলে উঠে আসছে নারদকাণ্ড, তার অনুষঙ্গে পুরোনো সারদা কেলেঙ্কারি, উড়াল পুল ভেঙে পড়া ইত্যাদি এবং তার প্রতিটির সঙ্গে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা। নির্বাচনী প্রচারে এসব প্রসঙ্গে এখন মমতাকে যে আত্মপক্ষ সমর্থনে বারবার কথা বলতে হচ্ছে, সেটা বিরোধীদের বড় সাফল্য। বিজেপির প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কংগ্রেসের হয়ে রাহুল গান্ধীও এসব প্রসঙ্গ তুলেই এখন মমতাকে বিঁধছেন, পুরো বিতর্কটাকে উসকে দিচ্ছেন। ২১, ২৫ ও ৩০ এপ্রিল কলকাতা ও তার চারপাশের জেলায় ভোট হবে। এর মধ্যে যদি মমতাবিরোধী হাওয়া আরও জোরালো হয়, তাহলে তা কিন্তু ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।