হাজি সেলিমপুত্রকে এখন ক্ষতিপূরণ দিন!

র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর ইরফান সেলিম


হাতি খাদে পড়লে চামচিকা লাথি মারে। আমরা জনগণ নামের কিছু চামচিকা সুযোগ পেয়ে লাথি মেরেছিলাম এক হাতিকে। সেই হাতি এখন খাদ থেকে ওঠার পথে।
হাতি খাদে পড়েছিলেন নিতান্ত ভাগ্যের দোষে। এমন সামান্য কাজে কোনো হাতি কখনো খাদে পড়ে না। কিন্তু কাজটি যাঁর সঙ্গে হয়েছে, তিনি ছিলেন সামান্যের ঊর্ধ্বে, ফলে হাতিকে খাদে পড়তেই হয়েছে।

সাংসদ হাজি সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমকে হাতি হিসেবে বিবেচনা না করে উপায় কী! তিনি শুধু একজন দাপুটে সাংসদের পুত্রই নন, নিজেও নির্বাচিত (সে নির্বাচন যেমনই হোক) কাউন্সিলর। সাংসদ বাবার গাড়িতে চড়ে তিনি শহর দাপিয়ে বেড়াবেন, তখন কোনো মোটরসাইকেলে ধাক্কা-টাক্কা লাগবে—এগুলো সবই স্বাভাবিক। কিন্তু এক রাতে একটি ‘ভুল’ মোটরসাইকেলে আঘাত করতেই বাধে যত বিপত্তি। তিনি, তাঁর গাড়ির চালক ও  সহযোগী—কেউই সেই মোটরসাইকেল ও তার চালককে চিনতে পারেননি, চেনার কথাও না। যেসব পোশাক দেখে আমরা মানুষকে গুরুত্ব দেই, হিসাব-নিকাশ করি, তেমন পোশাকে তিনি ছিলেন না। একজন সাংসদপুত্র কাম কাউন্সিলরের এবং তাঁর চালক ও সহযোগীর যে স্বাভাবিক আচরণ করার কথা, তাঁরা তা–ই করেছেন। মোটরসাইকেলচালককে তাঁরা মারধর করে রক্তাক্ত করেছেন। হাতির গর্তে পড়ার কাহিনির শুরু এভাবেই।

সাংসদপুত্রের সহযোগী ও তাঁর গাড়িচালকের মারধরের শিকার হয়েছেন সাধারণ পোশাকে থাকা একজন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত পরিচয় দিয়েও তিনি রক্ষা পাননি। কারণ, পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। নৌবাহিনী কর্মকর্তার রক্তাক্ত ভিডিও আমরা অনেকেই ফেসবুকে দেখেছি।

এরপর ঘটনা ঘটেছে দ্রুত। যে রাতে ঘটনা ঘটে, তার পরদিন (২৬ অক্টোবর) ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। সেদিনই পুরান ঢাকার বড় কাটরায় হাজি সেলিমের বাড়িতে র‌্যাব অভিযান চালায়। আটক হন দেহরক্ষীসহ ইরফান সেলিম। সেখান থেকে উদ্ধার হয় অস্ত্র, মাদক, দুরবিন, ওয়াকিটকি, হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেটসহ নানা সরঞ্জাম। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক রাখার দায়ে ইরফান সেলিমকে এক বছর আর অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে কারাদণ্ড দেন ছয় মাস। এর পরদিন, ২৭ অক্টোবর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ইরফানকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। ২৮ অক্টোবর মাদক ও অস্ত্র আইনে ইরফান ও তাঁর দেহরক্ষীর বিরুদ্ধে দুটি করে মোট ৪টি মামলা হয়।

হাতি খাদে পড়লে যা হয়, সংবাদমাধ্যমগুলোও তখন পেয়ে বসে ইরফান সেলিম ও তাঁর বাবা হাজি সেলিমকে। বাপ-ছেলে কোথায় কবে কী করেছেন, তার তত্ত্ব-তালাশ শুরু করে তারা। আমরা জানতে পারি, সোনারগাঁয়ে ১১ বিঘা সরকারি জমি দখল করে তিনি কারখানা গড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের তরফে উচ্ছেদ অভিযানও শুরু হয়।

হাতি খাদে পড়লে যা হয়, সংবাদমাধ্যমগুলোও তখন পেয়ে বসে ইরফান সেলিম ও তাঁর বাবা হাজি সেলিমকে। বাপ-ছেলে কোথায় কবে কী করেছেন, তার তত্ত্ব-তালাশ শুরু করে তারা। আমরা জানতে পারি, সোনারগাঁয়ে ১১ বিঘা সরকারি জমি দখল করে তিনি কারখানা গড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের তরফে উচ্ছেদ অভিযানও শুরু হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিটি হল দখল করে হাজি সেলিমের স্ত্রীর নামে মার্কেট বানিয়েছেন—এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে বের হয়।

হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলার যে ফাইলগুলোতে ধুলা জমেছিল, সেগুলো আবার সাফ করা শুরু হয়। সংবাদমাধ্যমের নানা খবরে সক্রিয় হয় দুদক। আমরা পত্রিকায় পড়েছি, ‘সাংসদ হাজি সেলিম ও তাঁর ছেলে ইরফান সেলিমের সম্পদ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা তথ্যগুলো খতিয়ে দেখছে দুদক’। এই ধাক্কায় অগ্রণী ব্যাংক হাজি সেলিমের দখলে থাকা জমি উদ্ধারও করে ফেলে।

এসব ঘটনার পর দুই মাসের বেশি সময় কেটে গেছে। ইরফান সেলিমকে জেল নামক গর্তেই কাটাতে হয়েছে। কিন্তু ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’। সেখান থেকে বের হওয়ার একটি পথ তৈরি হয়ে গেছে। পুলিশের একটি প্রতিবেদন সেই সুযোগ করে দিয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদন বলছে, ইরফান সেলিমের কাছে কোনো অস্ত্র ও মাদক ছিল না। তাঁর সহযোগী জাহিদের কাছ থেকে এই অস্ত্র ও মাদক পাওয়া গেছে। আমরা পড়লাম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কুদরত ই খুদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘ইরফান সেলিমের দুই মামলায় ফাইনাল প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ও মাদক মামলা ছিল, তা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বিষয়টি আরও খোলাসা করেছেন; বলেছেন, ‘অস্ত্র ও মাদক তাঁর সহযোগীর কাছে পাওয়া গেছে। তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। এখন সেগুলো মালখানায় আছে। পরবর্তীকালে আদালতে জমা দেওয়া হবে।’

পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ডিএমপির চকবাজার থানায় দায়ের হওয়া এই দুটি মামলার বাদী ছিল র‌্যাব। মামলার দুই মাসের মাথায় পুলিশের তরফে এই প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।

পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর ফেসবুকে দেখলাম, একসঙ্গে ওপর-নিচে সেই ছবিটির দুটি সংস্করণ। একটি আসল, একটি নকল। আগের ভাইরাল হওয়া ছবিটির সঙ্গে একটি নতুন ছবি; অস্ত্রপাতির বদলে কিছু খেলনাসহ ইরফান সেলিম। ছবির কারসাজির কাজ খুবই নিখুঁত। বোঝা মুশকিল কোনটি আসল আর কোনটি নকল!

ইরফান সেলিমের খাদে পড়ার পেছনে ফেসবুকের একটি ভূমিকা ছিল। কারণ, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা যখন ইরফান সেলিম গং–এর মারধরের শিকার হচ্ছিলেন, তার ভিডিও করেছিল পথচারীরা। সেই ভিডিও ফেসবুকে তোলা হয়েছে এবং তা ভাইরাল হয়েছে। এরপর ইরফান সেলিমের আটক হওয়া, র‌্যাবের অভিযান, উদ্ধার করা অস্ত্রসহ ইরফান সেলিমের ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর ফেসবুকে দেখলাম, একসঙ্গে ওপর-নিচে সেই ছবিটির দুটি সংস্করণ। একটি আসল, একটি নকল। আগের ভাইরাল হওয়া ছবিটির সঙ্গে একটি নতুন ছবি; অস্ত্রপাতির বদলে কিছু খেলনাসহ ইরফান সেলিম। ছবির কারসাজির কাজ খুবই নিখুঁত। বোঝা মুশকিল কোনটি আসল আর কোনটি নকল! ফেসবুক এক মজার জায়গা।

এরপরের খবর হচ্ছে, আদালত ৫ জানুয়ারি ‘ঢাকা–৭ আসনের সাংসদ হাজি সেলিমের ছেলে এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কমিশনার ইরফান সেলিমের জামিন মঞ্জুর করেছেন’। আমরা বুঝতে পারছি, মাস দুয়েকের জন্য যে খাদে পড়েছিলেন ইরফান সেলিম, তা থেকে তিনি খুব শিগগির উঠে পড়ছেন। কিন্তু হাতি খাদে পড়ার কারণে আমাদের মতো কিছু চামচিকা জনগণ যে সুযোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের কী হবে!

এখন ইরফান সেলিমের পক্ষে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুটা হলেও আমাদের অপরাধ স্খলন করতে পারি। আমরা দাবি তুলতে পারি, যেহেতু অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাই অবিলম্বে তাঁর কাউন্সিলর পদ ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো পূরণ করা মতো নয়। কিন্তু ‘বিনা অপরাধে’ তাঁকে যে দুই মাসের বেশি জেলে থাকতে হলো, সে জন্য অন্তত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হোক!

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপ–সম্পাদক
[email protected]