হামাস-ফাতাহ এক হতে পারবে তো?

হামাস তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সঙ্গে ঐক্যের চুক্তিতে পৌঁছার কথা ঘোষণা করলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উপত্যকার বাসিন্দারা। গাজা সিটি, ১২ অক্টোবর। ছবি: রয়টার্স
হামাস তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সঙ্গে ঐক্যের চুক্তিতে পৌঁছার কথা ঘোষণা করলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উপত্যকার বাসিন্দারা। গাজা সিটি, ১২ অক্টোবর। ছবি: রয়টার্স

গত সপ্তাহে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে মতৈক্যের সরকার গঠন নিয়ে যে আলোচনা হলো, তাতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মৃদু আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে আলোচনা সফল হতে পারে। কায়রোতে ১০ অক্টোবর তাদের বৈঠকের পর যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তার সুর ইতিবাচক হলেও এখনো কিছু কঠিন বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে, যেগুলো সমঝোতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের এখনো এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে গাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে এবং হামাসের সামরিক শাখার কী হবে। আর গাজার সরকারি কর্মকর্তাদেরই বা কী হবে, সেই সিদ্ধান্তও তাদের নিতে হবে।

ফাতাহর সঙ্গে লড়াইয়ের পর তাদের বিতাড়িত করেই হামাস ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জেতার পরও ফাতাহ তা মেনে নেয়নি। সে কারণে গাজা উপত্যকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য হামাসকে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা তৈরি করতে হয়েছিল। বর্তমানে গাজার জনজীবনের সবকিছুই হামাস নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতাল, রাজস্ব সংগ্রহ, নিরাপত্তা আর মিসর ও ইসরায়েলের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা—এসবই হামাস করে থাকে।

অন্য কথায়, গত ১০ বছরে সেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হামাস পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রযন্ত্র স্থাপন করেছে। তাহলে সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কী হবে? এগুলো কি রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে, নাকি সেখানে নতুন কর্তৃপক্ষ আসবে, যারা রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। প্রথমত, এক ক্ষেত্রেই এসব ভাঙচুর চলবে, নাকি পাইকারি হারে গাজার নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে যাবে? এসব প্রতিষ্ঠানের হামাস অনুগতদেরই–বা কী হবে?

এটা পরিষ্কার যে একীভবন-প্রক্রিয়া কেমন হবে, সে ব্যাপারে বিস্তৃত ধারণা না থাকলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। দেখা যাবে, প্রতিটি ব্যাপার আলাদাভাবে নিষ্পন্ন করা হবে। উভয় তরফের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনো কাঠামোর ব্যাপারে একমত না হলে এই একীভবন-প্রক্রিয়া সহজেই ব্যর্থ হতে পারে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস একাধিকবার এ কথা বলেছেন যে এই সমঝোতার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে গাজার ওপর ফিলিস্তিনের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ আরোপ। অক্টোবরের শুরুতে তিনি ঘোষণা দেন, ফিলিস্তিনি ভূমিতে ‘একটি শক্তি, একটি আইন ও নিরাপত্তা’ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো এই সমঝোতা-প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আপত্তি প্রত্যাহার করলেও এটা ধরে নেওয়া যাবে না যে গাজার অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে তারা অনন্তকাল নিশ্চুপ থাকবে। এই অস্ত্রগুলো বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে আছে, যার মধ্যে আছে হামাস, ইসলামিক জিহাদ, ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন ও পপুলার রেসিস্ট্যান্স কমিটি।

অন্যদিকে হামাস ঘোষণা দিয়েছে এবং এটা নিশ্চিত করে যাচ্ছে যে তার সশস্ত্র শাখার ভবিষ্যৎ সমঝোতা-প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে না। আর গাজার মতৈক্যের সরকার সংহত করতে তারা সশস্ত্র শাখা ভেঙে দেবে না। হামাস নিজ সেনাদের আশ্বস্ত করতে এটাসহ আরও বেশ কিছু বিবৃতি দিয়েছে, যারা এসব অস্ত্র জড়ো করতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে। হামাসের জন্য ব্যাপারটা খুবই সমস্যাজনক—এটা স্বীকার করেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও মিসরীয়রা ইঙ্গিত দিয়েছে, অযথা অচলাবস্থা সৃষ্টির ভয়ে তারা একদম শেষ পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিম তীরের মতো গাজায়ও একই নিরাপত্তা সমন্বয়ব্যবস্থা চালু করতে এলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? হামাস কি সেটা হতে দেবে?

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজায় যে নিরাপত্তা সমন্বয়ব্যবস্থা চালু করতে চাইবে, তাতে ইসরায়েলের সামরিক যান গাজার প্রান্ত পর্যন্ত চলে আসতে পারে। যার অর্থ হলো, সীমান্ত নিরাপত্তায় সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাজ হবে তা ইসরায়েলকে অবহিত করা। আর ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের জানাবে, গাজার কোনো কারখানায় অস্ত্র বানানো হচ্ছে কি না। তখন সেটা ভেঙে দিয়ে এর সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে হবে। এসব আগাম জানা ও না-জানা বিষয় হামাসের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হবে। তারা কি এর জন্য প্রস্তুত, নাকি তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা বন্ধ করে দিতে চায়।

কথা হচ্ছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যদি হামাসের কাছ থেকে গাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝে নেয়, তাহলে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলিদের অনুপ্রবেশ, তার বিমান হামলা ও নৌসেনাদের হাতে গাজার জেলেদের হেনস্তা হওয়া—এসব কিছুর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। দীর্ঘকাল এসব হামাসের জন্য অস্বস্তিকর ছিল, কারণ তার পক্ষে এসব সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। সে কারণে গাজাবাসী হামাসের নেতৃত্বের ওপর অসন্তুষ্ট হচ্ছিল।

শেষ যে বিষয়টি এই শান্তিচুক্তিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে তা হলো, গাজায় হামাস প্রভাবিত প্রতিষ্ঠানের ৫০ হাজার কর্মীর ভবিষ্যৎ। তাঁদের ওপর প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নির্ভরশীল। তাঁরাই ১০ বছর ধরে গাজার প্রশাসনের ভার বহন করে আসছেন। ফলে তাঁদের অধিকার লঙ্ঘন করা হলে বা বেতন-ভাতা ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করা হলে তাঁরা বেঁকে বসবেন। আগের আলোচনার সময় হামাস খুব একরোখা ছিল। তারা দাবি করেছে, এঁদের কর্মনিরাপত্তা নিশ্চিত ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মীদের সমমর্যাদা দিতে হবে।

গুজব আছে যে এঁদের বিষয় দেখভাল করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা এঁদের চাহিদার ভিত্তিতে সরকারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে। তবে কর্মনিরাপত্তার ব্যাপারটা তারা বিবেচনা করছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। তাহলে গাজার এই কর্মীদের নিরাপত্তা কে দেবে? আর তাঁদের মর্যাদা কী হবে, তা ঠিক হয়ে গেলে এঁদের বেতনই–বা কে দেবে?

মাঠের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়কে আপস করতে হবে। তাদের দলীয় ও সাংগঠনিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে ফিলিস্তিনের এ-জাতীয় প্রকল্প অর্জন করতে হবে। কিন্তু বিভাজনের ভূত তাদের তাড়িয়ে বেড়ালে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে না।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

আদনান আবু আমের: গাজার উম্মাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান।