হারিয়ে যাওয়া মফস্বলের গল্প

আমরা যারা মফস্বল শহরে বেড়ে উঠেছি, তারা ছেলেবেলায় শুনতাম, ঢাকার মানুষ প্রতিবেশীকে চেনে না। তাদের কোনো সমাজ নেই। অথচ আমরা পাড়া-মহল্লায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো বেড়ে উঠেছি। এর গাছ থেকে আতা ফল চুরি করা, ওর গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়া, অমুকের গাছ থেকে মেহেদি পাতা নিয়ে আসা, দল বেঁধে পুকুরে স্নান করতে যাওয়া ও বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলতে যাওয়া—এসব আমাদের জীবন প্রকৃত অর্থেই অনন্য করে তুলেছিল। শীতকালে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো ছিলই। বছরের ১২ মাস আমাদের আনন্দের কমতি ছিল না। আর এখন এত কিছু থাকা সত্ত্বেও যেন এই বস্তুর বড় অভাব।

এসবের অস্তিত্ব আর নেই, তা বলাই বাহুল্য। তবে এবারের ঈদে বাড়ি গিয়ে সবচেয়ে মন খারাপ করার মতো যে বিষয়টি ঘটল, তা হলো শৈশব-কৈশোরের খেলার মাঠের গারদে ঢুকে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। বলছি টাঙ্গাইল সদরের আকুরটাকুরপাড়ার বিবেকানন্দ হাইস্কুল মাঠের কথা। এই গত শতাব্দীর শেষ দিনগুলোতে এমন কোনো দিন ছিল না, যেদিন এই মাঠে কোনো না কোনো খেলা হতো। এমনকি এই মাঠে খেলা দেখতে টিকিটও কাটতে হয়েছে কখনো কখনো। গ্রীষ্মকালে ফুটবল আর শীতকালে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলার তোড়ে এই মাঠ কখনো ফাঁকাই পাওয়া যেত না। কিন্তু এই স্কুল মাঠে প্রবেশ করতে এখন দুটি ভারী ফটক পেরোতে হয়। আর স্কুলের চারপাশে গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। বটতলা মোড়ের কাছে অবস্থিত হওয়ায় একটি দোকানও খালি নেই। এতে স্কুলের আয়রোজগার বেড়েছে সন্দেহ নেই, স্কুলে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাহার দেখে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। তবে বিষয়টি এমন নয় যে পাড়ার ছেলে-ছোকরারা এখনো খেলাধুলা করতে চায়, কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের কারণে খেলতে পারে না। ছেলে-ছোকরাদের সেই আগ্রহও আর নেই।

টাঙ্গাইলের আকুরটাকুরপাড়ায় ফুটবল খেলতেন শাহ আলম। একসময় ঢাকায় প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগেও খেলেছেন। ক্যারিয়ার নিয়ে জীবনে তেমন কিছু ভাবেননি, এখন পাড়ায় বড় একটি মুদির দোকান দিয়েছেন। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতে মলিন হাসি দিয়ে বললেন, ‘চলছে জীবন একরকম’। পাড়ার কী অবস্থা, এ প্রশ্ন শুনে তাঁর মুখের হাসি যেন আরও মলিন হলো। বললেন, ‘আমাদের সেই দিন আর নেই, পোলাপান এখন সামাজিক কার্যক্রমে আগ্রহী না। মুঠোফোন আর মাদক সব শেষ করে দিচ্ছে। মূল কথা হলো, আমাদের সময়ের সেই বন্ধন আর নেই; অনেকেই ভালো আছে, কিন্তু সবাই যার যার মতো।’ তাঁর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সঙ্গে ছিল ছয় বছরের সন্তান, তার যেন আর তর সয় না, বাসায় ফিরে যে মুঠোফোনে কার্টুন দেখতে হবে তাকে।

টাঙ্গাইল সদরের আকুরটাকুরপাড়ার বিবেকানন্দ হাইস্কুল। গত শতাব্দীর শেষ দিনগুলোতে এমন কোনো দিন ছিল না, যেদিন এই স্কুলের মাঠে কোনো না কোনো খেলা হতো।
এখন সামাজিক মাধ্যমের যুগ, পুরো বিশ্ব মানুষের হাতের নাগালে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে আমরা যত বুঁদ হয়ে থাকছি, ততই যেন অসামাজিক হয়ে উঠছি। অথচ একসময় মনে হলেই কারও বাসায় যাওয়া হতো, কিন্তু এখন কারও বাসায় যাওয়া বা এমনকি পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়াও যেন অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যবিত্তের কাছে। ফলে একসময় যে পাড়া গমগম করত, সেখানে এখন রীতিমতো সুনসান নীরবতা বিরাজ করে।

আমরা দল বেঁধে খেলতে যেতাম। যার বাসা ছিল দূরে, সে আগে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে সবার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে মাঠে যেত। সেই ডাক শুনে আমরা কেউ আর ঘরে থাকতে পারতাম না। মনে হতো, রক্তে যেন নাচন লেগেছে। অথবা সেই ডাক মনে হতো হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো, যে বাঁশির মোহন ‍সুর শুনে আর স্থির থাকার উপায় ছিল না, পিছু নিতেই হতো, আগপিছ ভাবার অবকাশ ছিল না। বলা বাহুল্য, এ জন্য পিতার রক্তচক্ষু কত যে সহ্য করতে হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর পাড়ার বন্ধন এমন ছিল যে আমরা ছেলে-ছোকরারা পথের দূরত্ব কমাতে মূল সড়ক দিয়ে না গিয়ে আরেক বাড়ির ওপর দিয়ে মাঠে যেতাম। এতে তাঁরা খুব একটা আপত্তিও করতেন না। আবার কারও বাড়ির ছোট শিশু অন্যের বাড়িতে সারা দিন কাটিয়ে দিত, নিরাপত্তার ভীতি যেমন ছিল না, তেমনি অস্বস্তির ব্যাপার ছিল না সেটা।

এই শতকের শুরু থেকে দেশের মফস্বল শহরগুলোও বদলে যেতে শুরু করে। এককালের ছিমছাম ও গা-এলানো টাঙ্গাইল শহরের এমন কোনো মহল্লা নেই, যেখানে এখন বড় অ্যাপার্টমেন্ট নেই। বিভিন্ন উপজেলার মানুষ সন্তানদের পড়াশোনার জন্য শহরে আসছেন। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের শাখা হয়েছে শহরে। ফলে বাইরের মানুষ আসছেন শহরে। এতে বাড়ির চাহিদা বেড়েছে। পুরোনো বাসিন্দারা অনেকেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। শহরও ঝাঁ-চকচকে হয়েছে। মানুষ বেড়েছে, কিন্তু সমাজের যে প্রাণ, অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে বন্ধন, সেই বন্ধন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে মানুষেরা সব সময় নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ব্যস্ত থাকতেন, সেই মানুষেরা আজ স্রেফ হারিয়ে গেছেন। তবে মানুষের অর্থনৈতিক সুযোগ বেড়েছে। নানা কাজে ব্যস্ত থাকছেন তাঁরা, এটারও প্রয়োজন আছে। আবার আগে যেমন পাড়ায় পাড়ায় মারামারি-কাটাকাটি হতো, তা-ও কিছুটা কমেছে।

আরও পড়ুন

এখন সামাজিক মাধ্যমের যুগ, পুরো বিশ্ব মানুষের হাতের নাগালে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে আমরা যত বুঁদ হয়ে থাকছি, ততই যেন অসামাজিক হয়ে উঠছি। অথচ একসময় মনে হলেই কারও বাসায় যাওয়া হতো, কিন্তু এখন কারও বাসায় যাওয়া বা এমনকি পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়াও যেন অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মধ্যবিত্তের কাছে। ফলে একসময় যে পাড়া গমগম করত, সেখানে এখন রীতিমতো সুনসান নীরবতা বিরাজ করে।

খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমাজের অভিন্ন পরিসর। এই পরিসর না থাকলে সমাজের নানা অসুখ হয়—পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, সহনশীলতার অভাব, নিঃসঙ্গতা, আত্মহত্যা আরও নানা কিছু। এসবের চল উঠে যাওয়া সমাজের জন্য অশনিসংকেত বলেই মনে হয়। আর বিশ্বায়নের কারণে এখন বড় শহর ও ছোট শহরের পার্থক্য ঘুচে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা বিশ্ব তো এক গ্রামে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় ‍যা মেলে, অন্যান্য শহরেও এখন কমবেশি তা মিলছে। এসব হয়তো অনিবার্য ছিল, কিন্তু কিসের বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি, তা ভেবে দেখা মনে হয় জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

[email protected]