হারিয়ে যাওয়া যোদ্ধারা

.

যে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদের সবাইকে আমরা মনে রাখিনি। মার্চ ও ডিসেম্বর এলেই কেবল তাঁদের স্মরণে নানা উদ্যোগ-আয়োজন চলে। সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়। কালেভদ্রে কিছু অনুসন্ধান চলে, হয়তো নতুন কোনো তথ্য বেরিয়েও আসে। তবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সাধারণ মনোভাব এমন, যেন এ নিয়ে আমাদের জানা ও বোঝা সম্পূর্ণ হয়েছে। নতুন করে আর কিছু জানার কিংবা বোঝার নেই।
কিন্তু এমন মনোভাব ঠিক নয়। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আরও অনেক কিছু জানার বাকি রয়ে গেছে। কিছু বিষয়ে হয়তো জানা হয়েছে সামান্য, অজানা রয়েছে আরও অনেক তথ্য। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রও রয়ে গেছে অনেক।
এই ভাবনাগুলো মাথায় এল এ. কাইয়ুম খানের লেখা বিটারসুইট ভিক্টরি: আ ফ্রিডম ফাইটার্স টেল নামের একটি বই পড়তে পড়তে। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে, কাইয়ুম খানের বয়স তখন ২০ বছর, নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। ২৫ মার্চের রাতের বিভীষিকা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন; তেজতুরী বাজারের পৈতৃক বাড়িতে রাতভর আতঙ্কে ভুগেছেন সপরিবারে। হানাদারকবলিত ঢাকা নগরে অবরুদ্ধ অবস্থায় এপ্রিলের মাঝামাঝি তাঁর উপলব্ধি হয়, ‘এটা মৃতের জীবন: পাকিস্তানি সেনারা ইচ্ছা করল, আর যেকোনো মুহূর্তে আমাদের যে কেউ তাদের শিকারে পরিণত হলো। আমাদের কোনো অধিকার নাই, নাই কোনো আইনি সুরক্ষা। আর ওরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছে বাঙালির রক্তের জন্য ওদের তৃষ্ণা কী প্রবল। ঘর থেকে না বেরোলেই যে নিরাপদে বেঁচে থাকব, তারও কোনো নিশ্চয়তা নাই। বাইরে যাই কিংবা ঘরে থাকি—মৃত্যু কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। তার চেয়ে বরং যদি যুদ্ধ করি, তাহলে হয়তো দেশটা স্বাধীন হবে, আর দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে আমরা শহীদের মৃত্যু বরণ করতে পারি। কিন্তু যদি কিছুই না করি, যেমন আছি তেমনি করে হাত-পা গুটিয়ে যদি বসে থাকি, তাহলে ঘরের মধ্যেই গুলি খেয়ে মরতে পারি, শুধুই এ কারণে যে আমরা বাঙালি।’
কাইয়ুম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, যুদ্ধে যাবেন। একটি চিরকুটে ‘আমি আমার মাকে রক্ষা করার জন্য চললাম’ লিখে লুকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লেন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের এক ভোরে।
অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধযাত্রার এমন কাহিনি আমরা জানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেকেই যেন একেকজন কাইয়ুম খান। কিন্তু এই সর্বজনীন গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আরও কত না বিশিষ্ট, অজানা গল্প।
পুঙ্খানুপুঙ্খ অনেক বিবরণে ভরা বিটারসুইট ভিক্টরি কাইয়ুম খানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির বয়ানই বটে। তবে তিনি এমন অনেক মুহূর্ত ও প্রসঙ্গ বর্ণনা করেছেন, যখন পাঠকের বিস্ময়, আবেগ ও ঔৎসুক্য ব্যক্তি কাইয়ুম খানকে অতিক্রম করে যায়। ভাবিত করে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে, যাঁদের কথা বলা ও লেখা হয়েছে কম, জানা হয়েছে আরও কম, যাঁরা সবচেয়ে বিস্মৃত।
এমন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উল্লেখ করেছেন কাইয়ুম খান তাঁর বইটির ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠায়। ত্রিপুরার মতিনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কিছুদিন কাটানোর পর তিনি জানতে পারেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট গ্রুপকে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতরে হানাদার বাহিনীর সদস্যদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে। এ রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়েছে। তাঁরা ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া নতুন যোদ্ধা, অধিকাংশই গ্রামের ছেলে, কৃষক-খেতমজুরের সন্তান। তাঁরা যুদ্ধ করার পণ নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসতেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। মাত্র দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়েই তাঁদের অপারেশনে পাঠানো হতো। তিন-চারজনের একেকটি গ্রুপ, প্রত্যেককে দেওয়া হতো দুটি করে গ্রেনেড, আর দলনেতাকে দেওয়া হতো একটি মাত্র পিস্তল। তাঁদের কাজ ছিল গোপনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকে পড়া, পাকিস্তানি সেনাদের বিচ্ছিন্ন টহলচৌকি খুঁজে বের করা এবং অতর্কিতে সেখানে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সটকে পড়া। এ রকম চোরাগোপ্তা হামলা চালানোই ছিল তাঁদের একমাত্র কাজ, কোনো প্রকারের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া তাঁদের কাজ ছিল না। কারণ, সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করার প্রশিক্ষণ তাঁরা পাননি, তাঁদের সে রকম অস্ত্রও দেওয়া হয়নি।
কাইয়ুম খান লিখেছেন, এই যোদ্ধাদের অধিকাংশই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন, কিংবা ধরা পড়ে প্রথমে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারপর তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে, কিংবা শেষ পর্যন্ত তাঁদের কী পরিণতি হয়েছে তা আর জানা যায়নি। অর্থাৎ এই যোদ্ধারা স্রেফ হারিয়ে গেছেন।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) বাঙালি সদস্যরা, যাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা এ ধরনের অপারেশনের বিপদ সম্পর্কে ভালোই জানতেন এবং সে কারণেই এমন বেপরোয়া ও আত্মঘাতী অভিযানে যেতে অনাগ্রহী ছিলেন। তাহলে একমাত্র যাঁদের এই কাজে পাঠানো যায়, তাঁরা হলেন কৃষক-খেতমজুরদের সেই সব সন্তান, যাঁরা ছুটে এসেছেন যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করার সংকল্প নিয়ে। যাঁদের না আছে বিদ্যা, না আছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ।
এই যোদ্ধাদের এসব অপারেশনকে কাইয়ুম খান বর্ণনা করেছেন ‘বেপরোয়া, আত্মঘাতী’ মিশন হিসেবে। তাঁর মতে, এ ধরনের মিশনের খুব প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত, দিশেহারা করে তোলার জন্য। এপ্রিল, মে ও জুন পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন এই যোদ্ধারাই, কারণ তখনো মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ও তালিকাভুক্ত সদস্যদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি, তাঁদের পূর্ণোদ্যমে লড়াই শুরু করতে আরও কিছু সময় বাকি ছিল।
সামরিক যুদ্ধ–পরিকল্পনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে এই যোদ্ধাদের দিয়ে, কাইয়ুম খান যাঁদের বর্ণনা করেছেন ‘ব্রেভেস্ট সানস অব দ্য সয়েল’ বলে, এবং বেদনার সুরে লিখেছেন, ‘যাঁদের নামটুকুও আমাদের জানা নেই।’ ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ভাষ্য অনুসারে, (যেমনটি কাইয়ুম খান তাঁর বইতে লিখেছেন) যুদ্ধ-পরিকল্পনার একটা দিক ছিল এ রকম: ‘এই মাটির সবকিছুকে আমরা শত্রুর জন্য বিরূপ করে তুলব। শত্রুকে আমরা ঘুমাতে দেব না, তার খানাপিনা হারাম করে দেব, এমনকি সে হাগারও ফুরসত পাবে না। যদি সে বুলেটের আঘাতে মারা না পড়ে, মরবে হার্ট অ্যাটাকে। শত্রুর অবস্থা আমরা এমনই শোচনীয় করে তুলব যে সে প্রত্যেকটা ঝোপে-ঝাড়ে, গাছের আড়ালে, পাহাড়ে-টিলায়, গর্তে-গুহায়, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও দেখতে পাবে মুক্তিযোদ্ধাদের। তাকে এমনই হয়রান করে ফেলতে হবে, যেন গাছের পাতা ঝরার শব্দেও তার পিলে চমকে ওঠে আতঙ্কে। আমরা পাকিস্তানি সেনাদের এমন অবস্থা করব, যেন তারা প্রতিমুহূর্তে আমাদের আতঙ্কে ভোগে। এভাবে যখন সে কাহিল হয়ে পড়বে, যখন তার হাঁটু ভেঙে আসবে, তখন মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ করে দেবে তাকে।’
গেরিলা যুদ্ধের এই পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়েছিল নাম না-জানা সেই যোদ্ধাদের দ্বারা, যাঁদের অধিকাংশই হারিয়ে গেছেন। অবশ্য শুধু এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নয়, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়েই কিছু কম মাত্রায় এ ধরনের অপারেশন চলেছে, সেসব অপারেশনেও প্রচুর যোদ্ধা হারিয়ে গেছেন।
মার্চ উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকেই আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। হারিয়ে যাওয়া নাম না-জানা এই শহীদ যোদ্ধাদের কথা আজ বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা কাইয়ুম খান। বিটারসুইট ভিক্টরি বইটির জন্য তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ।
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
[email protected]