হাসপাতাল-ক্লিনিকে যদি আগুন লাগে

আমাদের দেশে ঘরবাড়ি, বস্তিসহ বিভিন্ন স্থাপনায় প্রায়ই আগুন লাগে। আগুনে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যায়। পোশাক কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লেগে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ মারা গেছে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। অগ্নিকাণ্ড এড়ানো এবং আগুন লাগলে কী করতে হবে, এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতনতার অভাব প্রকট। অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই
এমন কলকারখানা ও অন্যান্য স্থাপনার সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে, অলিগলিতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে আগুন নেভানোর যথাযথ ব্যবস্থা নেই।
কলকাতার আমড়ি হাসপাতালে ২০১১ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৯২ জন মারা যান। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রোগী। আগুন লেগেছিল হাসপাতালের বেসমেন্টে, যেখানে দাহ্য বস্তু স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। সে কারণে আগুন দ্রুত অন্য তলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। রোগীদের দ্রুত স্থানান্তরের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তাঁদের অনেকে আগুনে পুড়ে মারা যান। আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীর পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল।
আমাদের দেশের শহরকেন্দ্রিক হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই বহুতলবিশিষ্ট। ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে একের পর
এক তলা নির্মাণ করা হয়। চারপাশটা বেশ আঁটসাঁট করে কাচ দিয়ে আটকানো হয়। শীতাতপনিয়ন্ত্রণের জন্য এটা করা হয়। একটি বহুতল হাসপাতালে যে অনুপাতে লিফট ও নিরাপত্তা-সিঁড়ি থাকার কথা, তা থাকে না। পুরোনো আসবাব, কাগজপত্র, বৈদ্যুতিক তার, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি স্তূপ করে রাখা হয়। ফলে আগুন লাগলে রোগীসহ অন্য মানুষদের দ্রুত ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। এ রকম ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত মানুষের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়।

>জাপান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার উন্নত অনেক দেশেই মাসে অন্তত একবার অগ্নিনিরাপত্তা–ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আগুন লাগলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে সবার সচেতনতা ও প্রস্তুতির জন্য নিয়মিত ‘ফায়ার ড্রিল’ করা হয়


ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, একটি অগ্নিনিরাপদ সিঁড়ি থাকতে হবে এবং তা সম্পূর্ণ বাধামুক্ত হবে। দরজা এমন হবে, যেন জরুরি প্রয়োজনের সময় চাবি ছাড়াই বাইরের দিকে খোলা যাবে এবং তা সরাসরি কোনো উন্মুক্ত জায়গায় গিয়ে খুলবে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপদ সিঁড়ি থাকলেও সেটি প্রায়ই তালা মেরে আটকানো থাকে। এমনকি চাবি দূরে কোথাও রাখা থাকে, যা প্রয়োজনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সেই সিঁড়ি ব্যবহৃত হয় ধূমপানের জায়গা হিসেবে। এটাও দুর্ঘটনার আরেকটি প্রধান কারণ হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোতে জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিকচিহ্ন থাকার বিধান আছে। কিন্তু খুব কম প্রতিষ্ঠানেই এর যথাযথ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়।
যেকোনো স্থাপনায়, বিশেষ করে হাসপাতালে কমপক্ষে দুটি করে নিরাপত্তা-সিঁড়ি থাকতে হবে। সর্বোচ্চ যাতায়াতের দূরত্ব ২৩ মিটারের মধ্যে হতে হবে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা জেনে-বুঝেও সেটি মানছি না। তা ছাড়া রোগীদের বেড সরানোর জন্য করিডর ও প্যাসেজের প্রস্থ কমপক্ষে ২ দশমিক ৪ মিটার হতে হবে এবং ফায়ার রেটিং ন্যূনতম এক ঘণ্টা হতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রতি পাঁচটি শয্যার জন্য একটি করে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীদের গাড়ি মূল রাস্তার ওপরই পার্কিং করা হয়। ফলে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর সামনের রাস্তায় গাড়ি চলাচলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, যানজট লেগে থাকে। এ রকম অবস্থায় কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও সেখানে দ্রুত পৌঁছাতে পারে না।
জাপান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার উন্নত অনেক দেশেই মাসে অন্তত একবার অগ্নিনিরাপত্তা–ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আগুন লাগলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে সবার সচেতনতা ও প্রস্তুতির জন্য নিয়মিত ‘ফায়ার ড্রিল’ করা হয়। এই বিষয়টা এমন, মাসের যেকোনো দিনে হঠাৎ করে ভবনে সাইরেন বেজে উঠল এবং বলা হলো সবাইকে খুব দ্রুত নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে যে যেভাবে থাকে, সে অবস্থাতেই মাত্র দুই থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরের খোলা জায়গায় চলে যায়। এতে যদি কারও কোনো ধরনের সমস্যা হয়, পরবর্তী সময়ে সেগুলোর সুরাহা করা হয়। হাসপাতালের রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ট্রলি ও র্যা ম্প ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশের কলকারখানা, বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ভবনসহ হাসপাতাল, ক্লিনিক সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অফিস-আদালতসহ সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়মিত ফায়ার ড্রিলের চর্চা করা উচিত। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা, কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক দল সেখানে দ্রুত পৌঁছাতে পারে না। এটা তাদের অদক্ষতা নয়, বরং অবকাঠামোগত সমস্যা। রাস্তায় যানজট লেগে থাকলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুত পৌঁছানো অসম্ভব। জনবহুল ঘিঞ্জি এলাকায় যেকোনো সমস্যার মোকাবিলা করা অনেক কঠিন একটি কাজ। আমাদের দেশের ফায়ার সার্ভিস এখন আগের চেয়ে দক্ষ ও শক্তিশালী। তবু তাদের আসার আগ পর্যন্ত, বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে যেখানে শত শত রোগী থাকেন, যাঁরা আইসিইউতে অচেতন অবস্থায় থাকেন, কিংবা হাঁটাচলা করতে পারেন না, তাঁদের যাতে নিরাপদে বের করে নেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।