হুইলচেয়ারসহ যেতে চাই বহুদূর

আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি, আমার অস্ত্রোপচারের কয়েক মিনিট আগে যখন আমাকে বলা হলো, এতে আমার মৃত্যু হতে পারে, তখন আমি আমার গত ৩৭ বছরের সমস্ত ভালো স্মৃতি পুনরায় ভাবতে চেষ্টা করি এবং মনে মনে সব স্মৃতি একসঙ্গে জড়ো করি। আমার ছেলেটি কেবল আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠল এবং স্মৃতিগুলো ছিল তার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি অধীর উৎকণ্ঠা ও ভয়ে থাকি। ইচ্ছা করছিল সন্তানকে একবার দেখার জন্য, আমি আমার স্ত্রী ও মা–বাবাকে কল্পনায় বিদায় জানাই।
ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গিয়েছি, কিন্তু হারিয়েছি অনেক বেশি। মেরুদণ্ডের (মেরুরজ্জুর) আঘাতের কারণে আমার শরীরের ৮০ শতাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এটি ছিল বুক থেকে শরীরের সমস্ত অংশ। আমার প্রস্রাব ও পায়খানা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ভাবতে অবাক লাগে, আমাকে সর্বদা সঙ্গে করে প্রস্রাবের ব্যাগ বহন করতে হবে।
এই একই কারণে আমি আমার হাতের ৮০ শতাংশ কার্যক্ষমতা হারাই। আমার শরীরের ৮০ শতাংশ অনুভূতি, যেমন: ব্যথা ও তাপমাত্রা বোঝার ক্ষমতা নেই। এমনকি আমি নিজের খাবার খেতে এবং লিখতেও পারি না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, আমি আর কোনো দিন দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারব না। দীর্ঘদিন ধরে আমার কাছে এ অবস্থাকে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলো। ভাবতে থাকলাম শিগগিরই দুঃস্বপ্ন শেষ হবে এবং আমি পুনরায় আগের মতো হয়ে যাব। আমরা বিভিন্ন চিকিৎসা নিয়ে ভাবছিলাম, কিন্তু আঘাতের তীব্রতার কারণে তা করানো সম্ভব ছিল না।

দুর্ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ৩৭ বছর। আমি একটি সুখী ও সমৃদ্ধ পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করছিলাম। আমার জীবনের সবকিছু ছিল ছবির মতো সুন্দর এবং গোছানো। খুব ভালো এবং দারুণ সময় কাটিয়েছি। আমার মাঝেমধ্যে আফসোস লাগে, ইশ্‌, যদি আরও কিছুদিন এভাবে আমার পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারতাম।

আমি বহু দিন কেঁদেছি এবং কারও সঙ্গে কোনো কথা বলিনি। আমি নির্বাক ছিলাম এবং আমাকে একটা চিন্তা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল যে এখন আমার কী হবে? আমি দুই বছরের কাছাকাছি একটি বিশাল ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এরপরে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়ের। আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি এবং জীবনে যতটা সম্ভব ফিরে আসার চেষ্টা করি। আমি আমার পারিবারিক জীবন আবার ফিরে পেতে চেয়েছি এবং আমার ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ার সঙ্গী হওয়ার বাসনা জেগে উঠল। বিশ্বজুড়ে কিছু ইতিবাচক মানুষ আমাকে নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবতে উৎসাহ প্রদান করে এবং আমি আমার পরিস্থিতির সঙ্গে বদলে যাওয়া জন্য অনুপ্রাণিত হই। ইতিবাচক ব্যক্তিদের ইতিবাচক বাণী আমাকে ইতিবাচক হতে উৎস হিসেবে কাজ করে।
দুর্ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ৩৭ বছর। আমি একটি সুখী ও সমৃদ্ধ পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করছিলাম। আমার জীবনের সবকিছু ছিল ছবির মতো সুন্দর এবং গোছানো। খুব ভালো এবং দারুণ সময় কাটিয়েছি। আমার মাঝেমধ্যে আফসোস লাগে, ইশ্‌, যদি আরও কিছুদিন এভাবে আমার পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারতাম।
আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের যাত্রা শুরু করলাম। আমি শিখতে শুরু করলাম কীভাবে নতুন করে অন্যভাবে আমার এই জীবন চালানো সম্ভব। আমি শিখেছি কীভাবে প্রয়োজনীয় শারীরিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমার নতুন এ জীবনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিবর্তিত হতে হয়েছে। আমকে শেখানো হয়েছে কীভাবে এই অবস্থায় সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন করা যেতে পারে। আমি শিখেছি এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মূল এবং ছোট ছোট বিষয়।

হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য নেই কোনো উপযুক্ত যাতায়াতব্যবস্থা। আমি আমার প্রতিটি পদক্ষেপে অবাক হয়ে পড়ি। হুইলচেয়ার নিয়ে নতুন নতুন যে পরিস্থিতির স্বীকার হই বিভিন্ন জায়গায়, তা আমাকে হতবাক করে।

প্রথম প্রথম মনে হতো খুব বিরক্তিকর ও আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আমি তো হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। ধীরে ধীরে অনুশীলন ও পুনরাবৃত্তির ফলে তা আমার আয়ত্তের মধ্যে চলে এল। আমি সাত মাস সিআরপিতে কাটাই। এই সময় আমার জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এখানে এসে আমি প্রচুর মানসিক শক্তি অর্জন করি। এই মানসিক শক্তি আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এখানে আমি অনেক কিছু শিখেছি এবং আমার মতো প্রচুর রোগীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছি। আঘাতের ধরনভেদ এখানে প্রচুর রোগী রয়েছে এবং এখানে তারা প্রাণবন্ত জীবন যাপন করছে।
সিআরপির আঙিনাকে আলোকিত রাখতে তারাই যথেষ্ট। আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে সিআরপি একমাত্র বিশেষায়িত জায়গা, যেখানে মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপন করতে পারে।
আমি ধন্য আমার এই বর্ধিত জীবনের জন্য। আমি তো ওই মুহূর্তে মারাও যেতে পারতাম। আমি ধন্য পুনরায় পৃথিবীর আলো দেখার জন্য, আমি ধন্য আমার ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়ার জন্য, আমি ধন্য কিছু অসমাপ্ত কাজ করার সুযোগ পাওয়ার জন্য। জীবনের এই পরিস্থিতিতে আমার জীবন সম্পর্কে অনেক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। জীবনের এই দুঃসময়ে আমি আরও বেশি বাস্তববাদী ও পরিপক্ব হয়ে গেছি। তবে এই জীবনের পাওয়া হলো কিছু মানুষ যারা সত্যিকারে আমাকে ভালোবাসে এবং আমার প্রতি যত্নশীল। আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত অনুপযোগী।
হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য নেই কোনো উপযুক্ত যাতায়াতব্যবস্থা। আমি আমার প্রতিটি পদক্ষেপে অবাক হয়ে পড়ি। হুইলচেয়ার নিয়ে নতুন নতুন যে পরিস্থিতির স্বীকার হই বিভিন্ন জায়গায়, তা আমাকে হতবাক করে। আমি বুঝতে পারলাম, এই জীবন ও পরিস্থিতিতে বাঁচার উপায় হলো চুপ থাকা এবং নীরবে ত্যাগ স্বীকার করা।

সাধারণত ড্রপআউট বলতে আমরা বুঝি কোনো কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া। ভাগ্যক্রমে আমি এই তালিকায় নেই। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে আমার দুর্ঘটনা আমাকে আমার নিয়মিত জীবন থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি বাবা হিসাবে, স্বামী হিসেবে, পুত্র হিসেবে এবং আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কর্মজীবন এবং সমস্ত কিছু থেকে ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমি আমার স্বপ্ন ও লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়েছি।
সাধারণত সমস্ত ঝরে পড়া লোক জীবনযাপনের বিকল্প উপায় খুঁজে নেয় এবং প্রচুর লোক বিভিন্ন উপায়ে সাফল্য এবং সমৃদ্ধি অর্জনও করে। প্রতিটি মানুষের সাফল্যের পেছনে রয়েছে প্রচুর বাধা ও বিপত্তি পার করার ইতিহাস। আমি জানি, সাফল্য কখনো সহজ উপায়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রতিটি ড্রপআউট ব্যক্তি এবং তাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আমি আমার দুর্ঘটনার পরে নিজেকে ড্রপআউট ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করি। যেমনটি আমি আগে বলেছিলাম এবং এর পেছনে রয়েছে আমার নিজস্ব কারণ। প্রতিটি ঘটনা বা দুর্ঘটনার থাকে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া এবং আমি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারি যে জীবনে যেকোনো ধরনের ব্যথা বা যন্ত্রণা মানুষকে আরও দৃঢ় এবং নিখুঁত করে তোলে। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, দৃঢ় বিশ্বাস এবং মানসিক স্থিতিশীলতা যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি ও পরিবর্তন মেনে নিয়ে জীবন চলতে প্রেরণা দেয়।
আমি জানি, আমার অনেক শারীরিক সমস্যা রয়েছে। আমি আরও জানি, আমি আমার স্বপ্ন ও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। তবে একটু ভিন্নভাবে। শুধু আমাকে প্রতিটি বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে আমার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য। এ অবস্থায় আমার প্রতিটি ছোট ছোট অর্জন আমাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং আমাকে কাজ করে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়।
পরিশেষে বলতে চাই, আমি আমার এই হুইলচেয়ারসহ যেতে চাই দূর, আরও দূর, বহুদূর।

আসিফ ইকবাল চৌধুরী শারীরিক প্রতিবন্ধী ও ‘সফল কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ ২০১৯ হিসেবে পুরস্কৃত