হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

‘আমি ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে ছিলাম। হঠাৎ করে কয়েকজন ছাত্র এসে ঢুকল। ওদের একজন আমাকে বলল, ‘‘ওঠো মিয়া, বের হও, তোমার চাকরি নাই...।’’ ওদের চেহারায় আক্রোশ আর কথা বলার ধরন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা পরিকল্পনা করে এসেছে ওরা। আমি দ্রুত বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একজন আমার হাত ধরে ফেলল, “না, এইভাবে চলে গেলে হবে না, মাফ চাইতে হবে, যা করেছ, তার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”’

আমি চেয়ারম্যানের কামরা থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওরা কয়েকজন আমার সঙ্গে উঠে পড়ল লিফটে। নিচতলায় নামার পর ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে ওরা নিয়ে গেল বাইরে। ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে একজন শিক্ষককে ওরা কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ জামার কলার ধরে টানছে...ভাবতে পারেন! ৬৮ বছর বয়স আমার..., কর্মজীবনে শিক্ষকতা ছাড়া আর কিছুই করিনি...। কিছু ছাত্র আমার সঙ্গে এই আচরণ করতে পারল! একজন ছাত্র আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল...। এই স্মৃতি সারা জীবন ভুলতে পারব আমি?’ বলতে বলতে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের সারা শরীর কাঁপছিল, দুঃসহ এক যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে যাচ্ছিল মুখ।

সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিল না, শুধু ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম প্রবীণ অধ্যাপকের মুখের দিকে। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী রোডের তাঁর বাসভবনে গিয়ে দেখা গেল অদ্ভুত এক বিষণ্নতা ঘরজুড়ে। মাত্র দুজন মানুষই থাকেন এই গৃহে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নাসিমা আখতার। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনই ব্যাংকার। পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকায়। পিতার লাঞ্ছনার খবর শোনার পর থেকে উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে উঠেছেন তাঁরা, বারবার ফোনে খবর নিচ্ছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই এসে পৌঁছাবেন এখানে।

অধ্যাপক মাহমুদ বললেন, ‘হয়তো মেরেই ফেলত, আগুন লাগিয়ে দিত শরীরে। কিন্তু কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ঘিরে ধরেছিল আমাকে। ছাত্রীরা কেউ কেউ কাঁদছিল...।’ বলতে বলতে যেন সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলো ভেসে উঠছিল তাঁর মনে। ‘ওরা আমার হাত থেকে একটা বই কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে দূরে। আমার অসম্ভব প্রিয় একটা বই। দ্য ইংলিশ ক্রিটিক্যাল টেক্সট নামের এই বই আমি সযত্নে আগলে রেখেছি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। এখানে এ. জি. স্টক নামের একজন শিক্ষিকার অটোগ্রাফ ছিল, যিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবাকে পড়িয়েছেন, আমাকেও পড়িয়েছেন। ছাত্রাবস্থায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো আমার প্রিয় কয়েকজন শিক্ষকের মূল্যবান কিছু মন্তব্য আমি এ বইয়ের মার্জিনে লিখে রেখেছিলাম। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে যাওয়ার সময় আমি সব সময় বইটা সঙ্গে রাখতাম। আমার একটা হাত ভেঙে ফেললেও হয়তো আমি সহ্য করতে পারতাম, কিন্তু ওই বইটা ...।’ বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।

মাস তিনেক আগে ইউএসটিসির কিছু শিক্ষার্থী এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে তাঁকে হেনস্তা করেছিলেন। শ্রেণিকক্ষে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ যৌন প্রসঙ্গের অবতারণা করে পক্ষান্তরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু হালে পানি পায়নি সেই অভিযোগ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটিও অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই অধ্যাপক মাহমুদকে হেনস্তা করার বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন তখন। দেশ-বিদেশের পাঁচ শতাধিক শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি অধ্যাপক মাহমুদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অজ্ঞতাপ্রসূত বলে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাহিত্যের ক্লাসে নর-নারীর সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠতেই পারে। এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না এমন নিয়ম জারি করা হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্লাসে অ্যানাটমি ফিজিওলজির পাঠদানও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। তা ছাড়া মাসুদ মাহমুদের মতো অভিজ্ঞ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আলোচনার পরিধি কতটা বিস্তৃত করা দরকার, তার কোথায় সীমারেখা টানা দরকার, সেটা বুঝতে পারবেন না—এ কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই দীর্ঘ ৪০ বছর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে পাঠদান করেছেন তিনি। 

নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না থাকায় ইউএসটিসির কিছু শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে দেননি অধ্যাপক মাহমুদ। এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চাকরিচ্যুত কয়েকজন শিক্ষক এককাট্টা হয়ে মাসুদ মাহমুদকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ধোপে টেকেনি বলে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

অধ্যাপকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছেন যে ছাত্রটি, তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে তাঁর বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনার বিচার হবে কি না, নেপথ্যের কুশীলবেরা শনাক্ত হবে কি না, জানি না। 

অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় তাঁদের বিষাদগ্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার মনে পড়ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’