হেথায় তুকে মানাইচ্ছে না রে...

গাছটির করুণ মৃত্যু শুধু বয়সের ভারেই নয়, পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবেও
গাছটির করুণ মৃত্যু শুধু বয়সের ভারেই নয়, পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবেও

‘হায়, দ্যাখো গো, তু এখানে ক্যানে;
তু লাল পাহাড়ের দ্যাশে যা, রাঙামাটির দ্যাশে যা,
হেথায় তুকে মানাইচ্ছে না রে, এক্কেবারেই মানাইচ্ছে না রে।’
এই গানের কবি অরুণ চক্রবর্তী বলছেন, ‘একটি মহুয়াগাছকে নিয়ে কবিতাটি লেখা। শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়াগাছ দেখে মনে হয় গাছটা ঠিক জায়গায় নেই। কেউ ঠিক জায়গায় নেই, তাঁরা মিস প্লেসড, আনফিট, এভরি হয়্যার। হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার, হলাম ইঞ্জিনিয়ার, ঘণ্টা হলো। লিখছি কবিতা।’
রাজধানীর রমনাকে বলা হয় এই ‘নগরীর ফুসফুস’। রমনার মূল আকর্ষণ ফুসফুস ভরে শ্বাস নেওয়ার বিশাল সবুজ। সেই সবুজের মাঝে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী মহুয়াগাছটি মূল উপড়ে পড়ে গেছে। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলছেন, এত বড় আর এত প্রাচীন মহুয়াগাছ সম্ভবত দেশে আর নেই। রমনার উপড়ে যাওয়া অভিমানী মহুয়াগাছটি কি এত দিন পরে এসে বুঝতে পারল হেথায় তাকে মানাচ্ছে না? তাই কি তার চলে যাওয়া? এটি কি স্বেচ্ছামৃত্যু?

শতবর্ষী একটি প্রাচীন গাছ উপড়ে পড়েছে এটুকুই খবর নয়, মহুয়ার অভিমানী প্রস্থান আসলে প্রশ্ন তুলেছে রমনার ব্যবস্থাপনা নিয়েই। যে কেউ গিয়ে দেখবেন উপড়ে পড়া মহুয়াগাছটির ভেতরজুড়ে খোঁড়ল এবং উইপোকার বাসা। রমনা পার্কটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের, এই দপ্তরটি গোটা পার্কে ইট-পাথর-লোহার কাজ করে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে। তারা মহুয়াগাছটির গোড়াও বেশ পোক্তভাবেই বাঁধাই করেছে। বেঁধে দেওয়া চত্বরে পাথরে লাল-নীল-সবুজ রঙের প্রলেপও দিয়েছে। কিন্তু গাছটির গোড়ায় যে মাটি নেই, অথবা গাছটির ভেতরজুড়ে যে উইপোকা বাসা বেঁধেছে, তাঁর খোঁজ কে রাখে? গণপূর্তের প্রকৌশলীর তো এ কাজ নয়। রমনায় সাম্প্রতিককালে কোনো উদ্যানবিদের দেখা মিলেছে এমনটি বলা যাচ্ছে না। রমনায় গাছ বড় হচ্ছে, বুড়ো হচ্ছে, সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়ছে, সেগুলোর ডালপালা কেটে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে কোনো নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ যেমন নেই, তেমনি সার-মাটি দিয়ে পুরোনো গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান নয়। সামনে বর্ষা আসছে, এই বর্ষায় পার্কজুড়ে গাছ রোপণের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না সেটাও জানা যায় না। 

এটা ঠিক, গোটা রমনা পার্ক এখন ছোট ছোট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এই গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের দখলে রাখা জায়গার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তবে এতে ইট-পাথরের গাঁথুনির জন্য যত আগ্রহ, সবুজময় করার ক্ষেত্রে ততটা না। তবু এ কথা মানতেই হবে যে এঁদের প্রেমময় স্পর্শেই রমনা পার্ক জীবন্ত হয়ে আছে।

কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়, রাজধানীর ‘ফুসফুস’ বলে চিহ্নিত রমনা পার্কের সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্ব কে নেবে? ইট-পাথর-লোহার অংশটুকু না হয় পূর্ত মন্ত্রণালয় দেখল, কিন্তু শত শত প্রজাতির গাছ দেখবে কে? পার্ক অবশ্যই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, কিন্তু দিনভর সেই উন্মুক্ত চত্বরে যে উন্মত্ততা চলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কে নেবে? এই প্রশ্নগুলো তুলে ধরা হচ্ছে এ কারণেই যেন, পার্কটিতে সাধারণ ভ্রমণকারীদের অবস্থান নিরাপদ-সুখময় হয়, আবার পার্কের কোনো ক্ষতিসাধন না হয়। 

শতবর্ষী মহুয়াগাছটির করুণ মৃত্যু শুধু বয়সের ভারেই নয়, পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবেও। রমনার গাছগুলোর দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে এই অযত্ন-অবহেলার ছাপ। গোড়ায় মাটি নেই, সার কোনো দিন দেওয়া হয় কি না, এ জন্য কোনো বাজেট আছে কি না, কে সেই বাজেট খরচ করে—সবই জানার বাইরে। 

কবি তাঁর অনুভূতিময় কল্পনা দিয়ে শ্রীরামপুরের মিস প্লেসড, আনফিট মহুয়াগাছকে লাল পাহাড়ের দ্যাশে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু রমনার সবুজ চত্বরে আমরা তো কোনো মহুয়াগাছের অযত্ন-অবহেলার মৃত্যু বা অভিমানী আত্মহত্যা দেখতে চাই না। রমনাকে সবুজময় রাখতে সরকারি ও নাগরিক যৌথ উদ্যোগ অতি জরুরি। সেটি শুধু পরিবেশ দিবসের মিছিলে নয়, পুরোনো গাছ রক্ষা আর নতুন গাছ রোপণেও, পার্কটিকে পার্ক রাখার ক্ষেত্রেও।

আশা করি মহুয়ার মৃত্যু নিশ্চয়ই আমাদের সচেতন করবে।  

মনজুরুল আহসান বুলবুল: প্রধান সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন।