হেফাজতকে ছাড়তে পারবে আওয়ামী লীগ?

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনটি মহাসমাবেশের নামে যখন ঢাকা শহরে তাণ্ডব ঘটিয়েছিল, তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে উঠবে? সরকার তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেবে এবং তারাও সে জন্য শোকরানা জানাবে?

সে সময়ে সরকার কঠোর হাতে হেফাজতের তাণ্ডব মোকাবিলা করেছিল। অনেকের মতে, সরকারকে সাহস জুগিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। সাত বছর পর আমরা গণজাগরণ মঞ্চের হদিস পাই না। হেফাজতে ইসলামের নেতারা সরকারকে চোখ রাঙাচ্ছেন।

হেফাজতের তাণ্ডবের পর সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতকেও ব্রাকেটবন্দী করে বলতেন, তিন ‘অপশক্তির’ হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। কিছুদিন না যেতেই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, সরকারি দলের নেতা ও পদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ হাটহাজারীতে হেফাজতের দরবারে গিয়ে ধরনা দিচ্ছেন। সরকার হেফাজতের দাবি মেনে কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কওমি মাদ্রাসা বোর্ড গঠনের জন্য আইন করেছে। কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা পেয়েছে। এসবের মধ্যে দোষের কিছু নেই। এসব মাদ্রাসায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী আছেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় তদারকির বাইরে থাকবেন, তা কারোরই কাম্য নয়। প্রশ্ন হলো, তদারকিটা হেফাজতকে সরকার করছে, না সরকারকেই হেফাজত করছে?

যেকোনো রাষ্ট্রের ভাবাদর্শের একটি মাপকাঠি হলো পাঠ্যবই। আওয়ামী লীগ সরকার কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক শিক্ষানীতি চালু করে বেশ বাহ্বা নিয়েছিল। সেই শিক্ষানীতির ভিত্তিতে সরকার পাঠ্যবইও সাজিয়েছিল, তাতে সহায়তা করেছিলেন দেশের প্রগতিশীল শিক্ষাবিদেরা। হেফাজতের তা পছন্দ হয়নি। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের যেসব লেখা সম্পর্কে তারা আপত্তি করেছিল, সরকার সেসব বাদ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে হুমায়ুন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সানাউল হকের ‘সভা’, জসীমউদ্‌দীনের ‘দেশ’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, বাউল লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘খতিয়ান’ কবিতা। গদ্য রচনার মধ্যে আছে সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ কাহিনী’।

এত দিন আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় নিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপি বা চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও কেউ এভাবে পাঠ্যবই নিয়ে খবরদারি করতে পারেননি। পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া লেখাগুলো নিয়ে উদীচী একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। আমরা পড়ে দেখেছি, এর কোনোটিতে ইসলাম ধর্মবিরোধী কিছু নেই। তারপরও সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, তা সংবিধানে লেখা আছে। যাঁরাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, তাঁদের কর্তব্য সংবিধান অনুসরণ করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা কেবল মুখে বললেই হয় না, কাজেও প্রমাণ দিতে হয়।

পাঠ্যবই নিয়ে হেফাজতের অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করার কারণেই আজ ভাস্কর্য নিয়ে তারা মাঠ গরম করতে পেরেছে। ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত সোমবার কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সভাপতি মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে একদল আলেম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে বৈঠকে বেফাকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করা হয়। তাতে ১. মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ না করে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষের বিশ্বাস ও চেতনার আলোকে কোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত কোনো উত্তম বিকল্প সন্ধান; ২. তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবমাননাকর আচরণের ওপর কঠোর নজরদারি এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; ৩. অতীতে দ্বীনি আন্দোলনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের নিঃশর্ত মুক্তিদান ও মামলা প্রত্যাহার এবং আলেম-ওলামা, ইমাম-খতিব ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওপর সব ধরনের হয়রানি বন্ধ; ৪. সব দ্বীনি মাহফিল যথানিয়মে অনুষ্ঠানের অবাধ সুযোগ দেওয়া এবং ৫. আলেমদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার ও দায়িত্বহীন আচরণ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে।

মতপ্রকাশের অধিকার সবার আছে; ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজত তাদের মতপ্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তারা বলে দিতে পারে না এটা করা যাবে, ওটা করা যাবে না। ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতে ইসলাম এবারই প্রথম মাঠে নামেনি। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দেবী থেমিসের ভাস্কর্য বসালে তারা এর প্রতিবাদ করেছিল। পরে সরকার তা সুপ্রিম কোর্ট ভবনের পেছনে নিয়ে যায় এবং হেফাজত আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি।

এবার রাজধানীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ বন্ধের দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন আন্দোলন করে আসছে। ৪ ডিসেম্বর রাতে কুষ্টিয়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলেমদের প্রথম দিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত না হলেও উভয় পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। আরও অনেক দল ও সংগঠন সরকারের কাছে অনেক দাবি জানায়, স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু সরকার তাদের সঙ্গে বসার প্রযোজন বোধ করে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলেমদের বৈঠকের আগে ও পরে দুটি মামলা হওয়ার খবর এসেছে সাংবাদমাধ্যমে। আগের মামলাটি হয়েছে হেফাজতের দুই নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। পরে আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের ৩৬ নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করেছেন তাঁর এক আত্মীয়। দ্বিতীয় মামলা সম্পর্কে হেফাজতের নেতারা বলেছেন, এটি তাঁদের চাপে ফেলার কৌশল।

এই মুহূর্তে দেশের বড় সংকট করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি। প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। টিকা কবে পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত নয়। সেসব নিয়ে কথা না বলে ভাস্কর্যের ইস্যুকে নিয়ে শোরগোল তোলার পেছনে রহস্য কী? হেফাজতের মূল দাবিতে ১৩ দফায় নারী উন্নয়ন নীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের কথা বলা হয়েছিল। সরকার নারী উন্নয়ন নীতিকে অনেক আগেই হিমাগারে পাঠিয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি এখন হেফাজতমনস্ক হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অভাবিত বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করেছে। আগের মন্ত্রিসভায় যাঁরা হেফাজতের রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তাঁরা আর এখন মন্ত্রী নেই। আপসরফার এ–ও এক নজির বটে।

তাই রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, মাঠে আওয়ামী লীগের নেতারা হেফাজতের বিরুদ্ধে যতই জোশ দেখান না কেন, তলে–তলে আপসের রাস্তাও খোলা রেখেছেন। তাঁরা কখনো চাইবেন না হেফাজত ফের বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ব্রাকেটবন্দী হোক।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]