হেমন্তিকাদের সঙ্গে একদিন

‘হেমন্তিকা’র অফিসে দাপ্তরিক কাজ চলছে
‘হেমন্তিকা’র অফিসে দাপ্তরিক কাজ চলছে

সাদা শাড়ির নীল-গোলাপি-সবুজ ডুরে পাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে মাথায় নীল স্কার্ফ বাহারি ব্রুচ দিয়ে আটকানো। হাতে সবুজ পাথরের আংটি। বড় ঘরের মাথায় ছোট টেবিলের পেছনে বসে আছেন। পিতলের ঘণ্টি বাজিয়ে দপ্তর তত্ত্বাবধায়ককে ডাকছেন, কাগজপত্র দেখছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। হেমন্তিকাদের এই দাপুটে সভাপতি মিসেস নূরজাহান রশীদের বয়স ৮৫।
পাশে খাতাপত্রে মুখ গুঁজে হিসাবনিকাশে ব্যস্ত কোষাধ্যক্ষ মিসেস গুলশান আখতার খায়ের। কোরা জমিনে খয়েরি ব্লকপ্রিন্ট করা শাড়িতে পরিপাটি এই নীরব কর্মীর বয়স ৮০। তাঁকে সাহায্য করছেন বয়সে কিছুটা ছোট, মিষ্টি গোলাপি শাড়ি আর হাসিতে উজ্জ্বল, সাধারণ সম্পাদক আঞ্জুমান আরা আলম।
সচ্ছল প্রবীণ নারীদের সংগঠন ‘হেমন্তিকা’র বয়স হয়েছে ২৫ বছর। ঢাকার মিরপুরে নিজস্ব কার্যালয়ে প্রতি মাসের প্রথম সোমবার সব সদস্যের সাধারণ সভা বসে। মাসের শেষে বসে কর্মপরিষদের সভা। গত ২৭ মার্চ ছিল বিশেষ সাধারণ সভা। সুযোগ বুঝে সেদিনই তাঁদের লাল ইটের টিনের চালার বাংলোটিতে গিয়ে হাজির হই।
আমাকে পাশে বসিয়ে সভাপতি নূরজাহান রশীদ বলেন, ‘আমরা বয়স্করা যে আসি, কাপড় বের করি, পরি, এটা আমাদের জন্য মস্ত বড় কাজ। আসার উদ্দেশ্য, সবার সঙ্গে দেখা হবে। সেটা বিরাট আনন্দের ব্যাপার। টনিকের মতো কাজ করে।’
রজতজয়ন্তী গেছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। আয়তাকার বড় ঘরটির দেয়ালে এখনো দোল খাচ্ছে হলুদ-নীল-বেগুনি-গোলাপি কাগজের বড় বড় ফুল আর শিকল, দু-চারটি বেলুন। চোখে পড়ে রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ আখতার ইমামের সাদা চুলে ঘেরা প্রাণখোলা হাসিমুখের বড় একটি ছবি।
মিসেস ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রথম প্রভোস্ট ও দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। হেমন্তিকার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংগঠনটির সভাপতি। জন্মদাত্রী ছিলেন আরও দুজন প্রয়াত শিক্ষাবিদ—ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রহমত আরা হোসেন এবং হারম্যান মেইনার স্কুল ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নীলুফার মাহমুদ। তাঁদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বিদেশে চলে গেলে স্বামীর মৃত্যুর পর দুজনই নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা বুঝেছিলেন। এই তিন আদি উদ্যোক্তা সমব্যথী প্রবীণাদের একত্র করতে চেয়েছিলেন।
১৯৯১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে রহমত আরার ফ্ল্যাটে সাতজনকে নিয়ে সংগঠনের যাত্রা শুরু। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা সুফিয়া খাতুনের প্রস্তাবিত ‘হৈমন্তী’র সঙ্গে আখতার ইমামের পরামর্শে ‘কা’ যুক্ত হয়ে নামটি দাঁড়ায় ‘হেমন্তিকা’। সুফিয়া খাতুন ও জাহানারা রহমান এখন প্রবীণতম সদস্য। রজতজয়ন্তীতে সংগঠন তাঁদের রুপার আতরদান দিয়ে সম্মাননা জানিয়েছে। দুজনেরই বয়স ৯৪। এ পর্যন্ত ২০ জন সদস্য মারা গেছেন। এখন সদস্য আছেন ৪০ জন। সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত সংগঠনটির গঠনতন্ত্র বলছে, এর সদস্য হতে বয়স ৫০ পেরোতে হবে। তবে সদস্যদের ১০ শতাংশ এর কম বয়সী হতে পারবে। যোগদান ফি তিন হাজার টাকা। বছরে চাঁদা চার হাজার টাকা।
সুফিয়া খাতুন ছিলেন হেমন্তিকার প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। এখনকার কর্মপরিষদের তিনি সদস্য ও উপদেষ্টা। সেন্ট্রাল রোডের বাড়ি থেকে যানজট ঠেলে মিরপুরে প্রতিটি সভায় আসেন। তিনি বললেন, ‘প্রবীণ মহিলারা আগে কাজ করত, ছেলেমেয়ে সংসার দেখত। এখন সময় কাটে না, অবহেলিত। হেমন্তিকার উদ্দেশ্য, তাদের মন ভালো রাখা। দেহের চাহিদার মতো মনের খোরাক চাই—মনের কথা বলা, মনকে হালকা করা।’
আর তাঁরা চেয়েছিলেন, ক্রমে প্রবীণাদের অল্প খরচে থাকার জন্য একটি বৃদ্ধাবাস গড়ে তুলতে, যেখানে অনিবাসীদের জন্য চিকিৎসাসেবা, পরামর্শ ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে।
বৃদ্ধাবাস গড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি, কিন্তু পাকাপোক্ত সংগঠন হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, প্রবীণ দিবস, পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর আর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে অনুষ্ঠান হয়। শীতের শেষে থাকে পিকনিক। এসব অনুষ্ঠানে আর মাসিক সাধারণ সভাগুলোতে সদস্যরা গান করেন, নিজেদের লেখা গল্প-কবিতা-কথিকা পাঠ করেন, কৌতুক শোনান, সুখ-দুঃখের কথা বলেন, বার্ধক্যের সমস্যা নিয়ে পরামর্শ দেন। টুকিটাকি খেলা আর উপহার দেওয়া থাকে। আর থাকে মুখরোচক খানাপিনা, সদস্যদের বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা।
গত ২৭ মার্চের সভাতেও চটজলদি অনুষ্ঠান জমে উঠল। হেমন্তিকার ‘গানের পাখি’ লাভলী রহমানের সঙ্গে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’য় গলা মেলালেন কোষাধ্যক্ষ গুলশান আখতার আর সাধারণ সম্পাদক আঞ্জুমান আরা। সুফিয়া খাতুন আর ডা. সুলতানা আহম্মদ স্বরচিত কবিতা পড়লেন।
পরে আঞ্জুমান আরা বললেন, ‘বিয়ের পর গান থেমে গিয়েছিল। এখানে আসার পর থেকে গানের চর্চা আবার শুরু হলো।’ গুলশান আখতারের কথায়, ‘অনেকের অনেক সুপ্ত প্রতিভা আবার বিকশিত হচ্ছে।’ তাইফুন্নাহার চৌধুরীর মূল আকর্ষণ, এক বয়সী এক মনা অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া আর বাসা থেকে বের হওয়া।

>হেমন্তিকারা শীত টপকে একযোগে বসন্তের সাধনা করেন। ডা. সুলতানা যেমনটা বলেছিলেন, ‘এখানে এলে মনে হয় দখিনের জানালা। ফুরফুরে বাতাস। একটা নিজের ভুবন—পরস্পরের জন্য দরদ, পরস্পরের যত্ন নেওয়া।’

অনুষ্ঠানের বিবরণ আর সদস্যদের লেখাগুলো নিয়ে অনিয়মিত সংকলন বেরোয়। প্রথম দিককার লেখাগুলো খাতায় টুকে রেখেছেন সুফিয়া খাতুন। তাঁর একটি লেখায় আছে, ‘হেমন্তিকাকে আমরা আমাদের শেষ পারানির কড়ি হিসেবে গ্রহণ করেছি।’
সদস্যদের চাঁদা আর অনুদানের সঙ্গে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর অনুদান মিলিয়ে হেমন্তিকার ছোট তহবিল। সেই তহবিলের টাকাতে সরকারের কাছ থেকে মিরপুরে মিল্ক ভিটা সড়কের একটি গলিতে পাঁচ কাঠা জমি কেনা হয়েছিল। মাটি ভরাট করে সেখানে ঘর তোলার কাজ শেষ হয় ২০০৫ সালের শেষে। আখতার ইমামের নেতৃত্বে নিজেরাই ছোটাছুটি করে কীভাবে এসব কাজ করেছিলেন, সে কথা শোনালেন ডা. সুলতানা।
৭৫ বছর বয়সী স্ত্রীরোগবিদ ডা. সুলতানা এখন আকুপ্রেসারের চর্চায় ঝুঁকেছেন। সেদিন তিনি উত্তরা থেকে বাসে মিরপুর পৌঁছে রিকশা ধরেছিলেন। অবৈধ দোকানপাটে সয়লাব ঢালু গলিপথে রিকশাটি ঢুকল না। হেঁটে আসতে হলো। হেমন্তিকারাই দেনদরবার করে এ গলিপথ পাকা করিয়েছিলেন। এখন রাস্তাটি দখলমুক্ত করানোর জন্য বারিধারা নিবাসী সভাপতিসহ আরও কয়েকজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অফিসে দৌড়াদৌড়ি করছেন।
রজতজয়ন্তীতে ঘর সাজিয়েছিলেন ৭০ পেরোনো লাইলী রহমান। বাংলোর সামনে গাড়ি রাখার জায়গার দুই পাশের বাগান তিনি ঢেলে সাজাচ্ছেন। বললেন, সবাইকে আনন্দ দিতে বড় ভালো লাগে। সভা শেষে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হলো। অনেকের ডায়াবেটিস আছে বটে, কিন্তু পাটিসাপটা আর গাজরের হালুয়ার বাটিগুলো টপাটপ খালি হয়ে গেল!
সামনের সারির একটি চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিলেন পেঁয়াজরঙা ভাঁজভাঙা শাড়ি পরা এক হেমন্তিকা। নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে হয়। রোগাটে মুখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু সে মুখের প্রসন্ন ভাবটি মনে দাগ কাটে। জানলাম তিনি বেগম আখতার জাহান। বয়স ৮১; শাহীন কলেজে বাংলা পড়াতেন, উচ্চাঙ্গসংগীত গাইতেন। কিছুদিন পর তাঁকে ফোন করি। ফোন ধরলেন তাঁর ছেলে, ব্যাংকার ইফতেখার ইমাম। জানালেন, মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তিনি বললেন, ‘মা হেমন্তিকায় যেতে খুবই ভালোবাসতেন—কতবার বলেছি, আম্মা আপনার শরীর খারাপ, কেন যান? জোর করে যেতেন। বলতেন, গেলে ভালো লাগে।’
ড. এ এফ এম আতীকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণের অধ্যাপক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব। তাঁর মতে, প্রবীণদের জন্য এমন সংগঠন ‘অসম্ভব প্রয়োজন’। এমন মেলামেশা করলে তাঁরা পরস্পরের সহায় হতে পারেন। তিনি আরও বললেন, ‘নারীদের বার্ধক্য অনেক বেশি কষ্টের। প্রবীণারা প্রতি ক্ষেত্রে অনেক বেশি কষ্টে থাকেন। তাঁদের আগে থেকেই সংগঠিত হতে হবে।’
হেমন্তের পা শীতের দিকে। কিন্তু হেমন্তিকারা শীত টপকে একযোগে বসন্তের সাধনা করেন। ডা. সুলতানা যেমনটা বলেছিলেন, ‘এখানে এলে মনে হয় দখিনের জানালা। ফুরফুরে বাতাস। একটা নিজের ভুবন—পরস্পরের জন্য দরদ, পরস্পরের যত্ন নেওয়া।’
সভাপতির কথাটিও কানে লেগে আছে—‘আমরা এখনো ঝরে যাই নাই। এখনো প্রাণ আছে। এখনো সবুজ আছে।’
কুর্রাতুল-আইন-তাহমিনা: লেখক ও সাংবাদিক।