হেরেছেন মাখোঁ, জিতেছেন পুতিন-এরদোয়ান

পুতিনের মতো ব্যক্তিগতভাবে এরদোয়ানও নাগরনো কারাবাখ চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন
এএফপি

বৈশাখের ঝড়ের বেগে নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধপর্বের ইতি ঘটেছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষে ভূমধ্যসাগরে গ্রিস-তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ছিল, তখন হুট করেই নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আবার যখন বিশ্ব মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তখন যুদ্ধ শেষে শান্তি এসেছে। পশ্চিমের যুদ্ধের রাজনীতি বোঝার জন্য এটি একটি অর্থপূর্ণ টাইমলাইন। ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ জীবন হারিয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। আদতে এই যুদ্ধ আর্মেনিয়ার যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ ছিল আর্মেনিয়ার ওপর ফরাসিদের, বিশেষ করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। মাখোঁ তাতে পরাজিত হয়েছেন। শক্ত হয়েছে পুতিন-এরদোয়ানের সম্পর্ক। এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাইডেন প্রশাসনের জন্য খটখটে হতে পারে।

সাম্প্রতিক কালে ইউরোপের উগ্র ডানপন্থী খ্রিষ্টানদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন এমানুয়েল মাখোঁ। ২০২২ সালের নির্বাচনে জয়লাভ আর করোনায় মুখ থুবড়ে পড়া ফরাসি অর্থনৈতিক সংকট থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে মাখোঁ বর্ণবাদ, ইসলামভীতির বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন। বৃহৎ অর্থে মাখোঁর বেপরোয়া এই যাত্রার শুরু হয়েছিল গত গ্রীষ্মে, যখন লিবিয়ায় আঙ্কারার প্রভাবের দরুন ফরাসিদের পররাষ্ট্রনীতি মচকে গিয়েছিল। আহত ওই পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতিতে রং দিতে আকস্মিকভাবে সেপ্টেম্বরে ভূমধ্যসাগরে নিজস্ব যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল ফরাসিরা। ওই যুদ্ধ থেকে মাখোঁর লক্ষ্য ছিল দুটি। প্রথমত, গ্রিসের কাছে রাফায়েল যুদ্ধবিমান বিক্রি এবং নিজেকে ইউরোপের পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জার্মানির সীমিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আঙ্কারার অনড় অবস্থান এবং মার্কিনদের, বিশেষ করে ট্রাম্পের নীরব অবস্থান ফরাসিদের যুদ্ধচেষ্টা থামিয়ে দিয়েছিল।

লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগরে ব্যর্থ হয়ে নিরাশ ও অনভিজ্ঞ মাখোঁ আঞ্চলিক রাজনীতির অলিগলি আমলে না নিয়ে আকস্মিকভাবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আর্মেনিয়াকে যুদ্ধে নামান। কিন্তু রাশিয়ার নীরবতায় আর্মেনিয়া পরাজিত হলে মাখোঁকে আবারও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। নাগোরনো কারাবাখে আগামী নির্বাচনে জেতার রসদ না পেয়ে আর্মেনিয়ার পর এবার মাখোঁর বর্ণবাদের শিকার হন স্বদেশি ফরাসি মুসলমানরা। এক অর্বাচীন চেচেন যুবকের সন্ত্রাসের দরুন রাষ্ট্রীয়ভাবে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ক্রমাগত পরাজয় ঢেকে দেওয়া। আগ্রহী পাঠকেরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, মাখোঁর পরবর্তী বলির শিকার হবে কোন দেশ অথবা কোন জাতি?

এই যুদ্ধ ছিল আর্মেনিয়ার ওপর ফরাসিদের, বিশেষ করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। মাখোঁ তাতে পরাজিত হয়েছেন। শক্ত হয়েছে পুতিন-এরদোয়ানের সম্পর্ক। এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাইডেন প্রশাসনের জন্য খটখটে হতে পারে।

মাখোঁর এই দুর্দিনে সুদিন ফিরেছে পুতিন ও এরদোয়ানের। লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগরের ঘটনার মতোই নাগোরনো কারাবাখের ঘটনার সাফল্যের ফসল উঠেছে পুতিন ও এরদোয়ানের ঘরে। গতিশীল মস্কো-আঙ্কারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। মস্কো-আঙ্কারার এই পরিবর্তিত সম্পর্ক যদি সিরিয়ার ইদলিব ও লিবিয়ায় একযোগে কাজ করতে সক্ষম হয়, তাহলে জো বাইডেন প্রশাসন ও ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের জন্য আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইচ্ছানুযায়ী ছড়ি ঘোরানোর পরিসর সংকীর্ণ হবে। পুতিন এই শান্তিচুক্তির কারিগর হয়ে এক ঢিলে বেশ কয়েকটি পাখি শিকার করেছেন।

প্রথমত, নভেম্বরের ১০ তারিখে স্বাক্ষরিত হওয়া শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মস্কো ককেশাস অঞ্চলের দেশসমূহকে একটি সুনির্দিষ্ট বার্তা দিয়েছে। বার্তা হলো ককেশাস অঞ্চলে কোনোভাবেই মার্কিনপ্রীতি মেনে নেওয়া হবে না। অতীতে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে ইউরোপে এবং ন্যাটোকে মস্কো একই বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু আফসোস, নিকল পাশিনিয়ান এবং আর্মেনিয়া স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটেছে। সাজাও মিলেছে তৎক্ষণাৎ।

পুতিনের দ্বিতীয় বার্তা ছিল বাইডেন প্রশাসনের জন্য। এই শান্তিচুক্তির দরুন মূলত পুতিন মার্কিনদের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে গঠিত মিনস্ক গ্রুপের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিলেন। মিনস্ক গ্রুপের প্রধান কাজ ছিল আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার সংঘর্ষের সমাধান বের করা। কিন্তু গত ৩০ বছরে মিনস্ক গ্রুপ ব্যর্থ হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাশিয়া সমাধান প্রদান করে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে মস্কোর কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। এই কার্যকারিতা রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার বাইডেন ও ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের ক্রমাগত হুংকারকে আগামী দিনে নিঃসন্দেহে অনেকটাই কাগুজে বাঘে পরিণত করবে।

পুতিনের মতো ব্যক্তিগতভাবে এরদোয়ানও এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন। হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনে আঙ্কারার ওপর এস-৪০০ এবং ভূমধ্যসাগরের সীমানাসংক্রান্ত বিবাদের দরুন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের বিপুল আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আপাতদৃষ্টে রাশিয়ার সঙ্গে আঙ্কারা এই শান্তিচুক্তির অন্যতম অংশীদার হয়ে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বার্তা দিতে সফল হয়েছে যে ক্রমাগত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার কেবল ঘনিষ্ঠতাই বাড়াবে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে সিরিয়া, লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগর নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে। তাই অবরোধ নয়, আলোচনাতেই রয়েছে সমাধান। একই সঙ্গে এই বিজয় তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়া এরদোয়ানকে জাতিবাদী ও রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে টানার টনিক দিয়েছে। যদি এই টনিক ব্যবহার করে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে স্বল্প পরিসরে হলেও এরদোয়ান সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে আগামী গ্রীষ্মে সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের ‘স্থায়ী’ একটি সমাধানের সম্ভাবনা আশা করা যায়।

দুনিয়া যখন ফরাসিদের মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধ এবং মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তখন চীন ১৫ নভেম্বর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশকে নিয়ে গঠন করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক জোট। চীন রাশিয়াকেই অনুসরণ করেছে। রাশিয়া যেভাবে মার্কিনদের বাদ দিয়ে নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধের সমাধান করেছে, ঠিক একইভাবে চীন মার্কিনবিহীন অর্থনৈতিক জোট গড়ে তুলেছে, যেখানে প্রথাগতভাবে মার্কিন মিত্র অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াও জায়গা করে নিয়েছে। সমকালীন ইতিহাসে মার্কিনদের বাইরে রেখে এই ধরনের অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক জোটের দেখা মেলা ভার। নাগোরনো কারাবাখের শান্তিচুক্তি এবং চিনের বাণিজ্যিক জোট গঠনের বিষয়টি দুনিয়ার সামনে মার্কিনদের ‘দুর্বলতার’ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। তাই বাইডেন প্রশাসনের চীন-রাশিয়া এবং স্বল্প পরিসরে আঙ্কারাকে মোকাবিলার কৌশলই আগামীর বিশ্ব শক্তির ক্ষমতাকাঠামোর অবয়ব নির্মাণে বিশাল ভূমিকা রাখবে।

রাহুল আনজুম আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক গবেষক।