১৪৩ চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

গত ৩০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে সকালে র্যালি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যাইনি। আমার শিডিউেল অপারেশন ছিল ওই দিন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। বিশেষ করে, বিভাগীয় আলোচনা সভায়। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে এটি এক নতুন উদ্যোগ, নতুন সংযোজন।
আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডিবদ্ধ কর্মসূচির বাইরে প্রতিটি বিভাগে আলোচনা সভার উদ্যোগ! যাঁদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সেই ছাত্ররা মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁদের অভিমত জানাবেন, সেসব অভিমত লিপিবদ্ধ করে তিন কর্মদিবসের ভেতর রেজিস্ট্রার অফিসে জমা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই অভিমত সম্পাদনা করে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এ ধরনের উদ্যোগে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। চার দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। এ ধরনের পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে দ্বিধাহীন সমর্থনের দাবি রাখে। ভেবেছিলাম, আমাদের বিভাগে এ সভা আয়োজন করব। যথাসময়ে বৈঠক যাতে শুরু করতে পারি, সে পরিকল্পনাতেই অস্ত্রোপচারের তালিকা তৈরি। অস্ত্রোপচারের দিন সকালে আমাকে প্রথাগতভাবে রোগী দেখানো হয়। আমাদের সহকারী অধ্যাপক তা দেখিয়ে থাকেন। আজও রোগী দেখিয়ে অস্ত্রোপচারের পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি হয়েছে। তাঁর সঙ্গী সহকর্মীরা চলে গেলে আমাকে সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘স্যার, আগামীকাল থেকে আমি আর ডিপার্টমেন্টে আসব না।’
‘কেন?’
‘একেকজন একেক কথা বলে। আমাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করে। চাকরি নেই। জোর করে কাজ করছি!’ বলে ম্লান মুখে আমার দিকে তাকান। আমি আমার প্রিয় ছাত্রের (সহকারী অধ্যাপক) নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে কী অভিমত দেব? আমার ক্ষমতা তো সীমিত! আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এক চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠিতে লিখেছিলাম, মাননীয় আদালতের পূর্ণ রায়ের কপি হাতে না আসা অবধি আমাদের বিভাগের শিক্ষক চিকিৎসকদের কাজ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার পত্র পেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি কেন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করে উল্টো ‘দোষী সাব্যস্ত’ শিক্ষক চিকিৎসকদের পক্ষে পত্র দিয়েছি? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আসীন প্রফেশনাল আন্দোলন-সংগ্রামে একসময়কার সাথিদের কাছ থেকে ১৪৩ জন শিক্ষক চিকিৎসকের অনিশ্চিত জীবনের নিষ্পত্তি হওয়ার সন্ধিক্ষণে সহানুভূতির এতটুকু ছোঁয়া পাবেন না, তা কখনো ভাবিনি।
উল্লেখ্য, জোট শাসনামলে তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর তাঁর ক্ষমতাবলে বেশ কিছুসংখ্যক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতাবলে এ ধরনের ব্যাপকসংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়টি দলীয়করণের অনুষঙ্গে প্রশ্নের উদ্রেক করে। আদালতে বিশ্ববিদ্যালয় বনাম ইকবাল আর্সনাল এ হিসেবে বিষয়টি বিচারাধীন ছিল। দীর্ঘ এক যুগের ওপর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়, ওই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরা বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করে এসেছেন।
চাকরির ধারাবাহিকতায় অনেকেই পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এঁদের অনেকেই প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক চিকিৎসক। মেধা ও দক্ষতার ছাপ রয়েছে বিভিন্ন পর্বে। আমাদের বিভাগে পাঁচজন শিক্ষক-চিকিৎসক রয়েছেন এই ১৪৩ জন চিকিৎসকের তালিকায়। এঁদের সবাই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সরাসরি আমার ছাত্র। এঁদের ভেতর তিনজন ইতিমধ্যে শিক্ষকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তাঁদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা তাঁদের কর্মোদ্যম নিবিষ্টতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
সেই ২০০৬ থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন পর্বে প্রশাসনের পরিবর্তনের সঙ্গে এঁদের উৎকণ্ঠিত চিত্তে প্রশাসনের কাছে ছুটতে দেখেছি। প্রতিবারই ফিরে এসে হাসিমুখে জানিয়েছেন, ভিসি স্যার বলেছেন আমাদের কাজ করে যেতে। কর্তৃপক্ষের অভিমত পেয়ে এঁরা যে কীভাবে এসে কাজে লেগে যেতেন, তা কেবল দেখার বিষয় নয়, অনুভবের বিষয়।
আমি মুক্তিযোদ্ধা। প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। বঙ্গবন্ধুকে আমি ভালোবাসি। আমার চিন্তাজগতের একটা অংশজুড়ে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন। আমাদের এ প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক যোগাযোগের অনেক বিষয়ই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমাদের স্বাধীনতা লাভের পরপরই এ প্রতিষ্ঠানে শাহবাগ হোটেল কর্মচারীদের সঙ্গে তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সাহেবের সৃষ্ট দ্বন্দ্ব নিরসনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগ এ প্রতিষ্ঠানটির অভিযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষাসেবার ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসকের কর্মপ্রয়াস রোগীদের প্রশংসা শুনে ভালো লাগে। যদি ওই সব চিকিৎসক নিজস্ব ছাত্র হন, তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অভিযুক্ত ১৪৩ চিকিৎসকের ভেতর এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের ভূমিকা গর্ব করার মতো।
দীর্ঘ এক যুগ চাকরির পর এসব চিকিৎসকের এ প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিতে হবে। আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের দেখেছি স্ত্রী, সন্তানসহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক হিসেবে স্বামী বা স্ত্রীর কাছে তা ছিল গর্বের, সন্তানের কাছে আনন্দের, গৌরবের। দীর্ঘ এক যুগ পর নিয়োগ অবৈধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিদায় নেওয়ার বিষয়টি স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের কাছে কেমন অনুভূতি নিয়ে উপস্থিত হবে, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিভাবক হিসেবে কখনো কি ভেবে দেখেছে? আমরা যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছি, আমাদের এসব সহকর্মীদের এ পরিণতি কি আমাদের বিবেককে কোনো নাড়া দেয় না?
আমি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে কোনো আনন্দ পাইনি। আমার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। আমার সামনে আমার প্রিয় ছাত্র, আমার প্রিয় সহকর্মী যখন দাঁড়িয়ে বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীকাল তিনি আর আসবেন না, তখন একধরনের বোবা কান্নায় আপন অনুভূতি প্রকাশের বিকল্প কিছু থাকে না। আমার যে হাত একসময় ছাত্রজীবনে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী স্লোগানে উৎক্ষিপ্ত হতো, আজ তা কেমন জানি নিথর, নিস্পন্দ। আমরা আমাদের সহকর্মীদের জন্য এতটুকু সহমর্মিতা প্রকাশ করার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি!
অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।