১৮ মাস পর স্কুল: যা মাথায় রাখতেই হবে

করোনা সংক্রমণের হার কমে আসায় সরকারিভাবে দেশের সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৮ মাস বন্ধের পর এটি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক সংবাদ। সংবাদমাধ্যমে লক্ষ করেছি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা, মাস্ক পরা ইত্যাদিসহ সব ধরনের শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই স্কুল ও কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি তাদের একাডেমিক বিষয়গুলোও যেন সমানভাবে গুরুত্ব পায়।

শিক্ষাবর্ষের কথা ধরা যাক। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের নয় মাস পার হয়ে যাচ্ছে। কাজে প্রথমেই আমাদের ভাবতে হবে মাত্র তিন মাসে পরীক্ষা না নিয়ে শিশুদের পরবর্তী ক্লাসের জন্য আমরা অটো পাস দেব কি না? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনে রাখা দরকার, ২০২০ সালে যে শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে, তাকে আমরা অটো পাস দিয়ে ২০২১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তুলে দিয়েছি।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ এ রকম শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৮ মাসে তেমন কিছু শিখতে পারেনি বলেই আমার বিশ্বাস। প্রথমত, শিক্ষা ও স্কুলের ব্যাপারটি তার অভ্যাসের অংশ হওয়ার আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর গ্রামের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের পক্ষে টেলিভিশন বা অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। একে তো ডিভাইস নেই; আবার ‘শেখার’ ব্যাপারটাও তার কিন্তু শেখা হয়ে ওঠেনি। এখন যদি মাত্র তিন মাসে তাকে দু-দুটি শিক্ষাবর্ষের যোগ্যতা অর্জন ব্যতিরেকে তৃতীয় শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি তার শিক্ষাজীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঠন-পাঠনের পাশাপাশি স্কুলে আসা, শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ, দলীয় কাজ ও সামাজিক নিয়মকানুনের সঙ্গে কিন্তু তার পরিচয় হয়নি।

একইভাবে, যে শিশু ২০২০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল, ইতিমধ্যে সে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির অনেক সময় পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। এখন যদি তাকে আমরা আবারও অটো পাস দিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে তুলে দিই, তাহলে সেটি তার জন্যও সুখকর হবে না। কারণ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে অনেক নতুন বিষয়, অনেক বিষয়ের নতুন অধ্যায় তার কাছে ইন্ট্রোডিউস হওয়ার কথা। যেমন: বীজগণিতে হাতেখড়ি, জ্যামিতির এক্সট্রা সমাধান করা ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে অনেক শিক্ষার্থী টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে তাদের এই শিখনফলগুলো অর্জন করতে পারেনি।

সরকারিভাবে টেলিভিশন ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক শিখন হলেও সেটি যে স্কুলের মতো কাজ করেছে, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ এখনো ই-লার্নিংয়ের জন্য প্রস্তুত হয়নি। এখন যদি আমরা এই শিক্ষার্থীদের অটো পাস দিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে তুলে দিই, তাহলে এই ১৮ মাসে যেসব শিখনফল বা শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা তাদের অর্জন করার কথা ছিল, সেগুলো অর্জন না করেই তারা পরবর্তী শ্রেণিতে চলে যাবে। এ থেকে উত্তরণের একটি পথ হলো শিক্ষাবর্ষকে প্রলম্বিত করা।

কাজেই বর্তমান শিক্ষাবর্ষকে অনায়াসে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বর্তমান শ্রেণির যোগ্যতা ও শিখনফল অর্জনে এবং পরবর্তী শ্রেণির জন্য তৈরি করতে স্কুলগুলো কমবেশি ছয় মাস সময় পাবে। এপ্রিল মাসে পবিত্র রোজা শুরু হবে। শিক্ষার্থীরা বার্ষিক ছুটি পাবে এবং রোজার ঈদের শেষে নতুন শ্রেণিতে ক্লাস শুরু করবে। একই ভাবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রলম্বিত করে ২০২৪ সালে আবার জানুয়ারি-ডিসেম্বর শিক্ষাবর্ষে ফিরতে পারব।

দ্বিতীয়ত, চেষ্টা করতে হবে শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের সঙ্গে ক্যাম্পাসে ফিরতে পারে।

দীর্ঘ ১৮ মাস পর আমাদের নতুন প্রজন্ম আবারও হাসি-আনন্দে স্কুলে ফেরত যাচ্ছে। নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে আমরা যাতে তাদের এই ফেরাকে শিক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য অর্থবহ করে তুলতে পারি, সেটিই যেন আমাদের লক্ষ্য হয়।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, স্কুল খোলার পরপরই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি পেয়ে বসতে পারে। কারণ অনেক শিক্ষক এখনই ‘এবারের পরীক্ষা কঠিন হবে’ মর্মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ শুরু করেছেন! মনে রাখতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) পরীক্ষা চলতি শিক্ষাবর্ষে নেওয়াটা হবে একটি বিলাসিতা, যা মোটেই কাম্য নয়।

এ ছাড়া স্কুল-কলেজগুলো যাতে শ্রেণি পরীক্ষা, সাময়িক ইত্যাদি পরীক্ষার নামে কর্মদিবস অপচয় করতে না পারে, সেদিকে কঠিন দৃষ্টি রাখতে হবে। পরীক্ষা যোগ্যতা যাচাইয়ের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। এ ক্ষেত্রে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালের মার্চ মাসে তাদের একমাত্র বার্ষিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, যারা ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাদের পরিমার্জিত সিলেবাসের পরীক্ষা হবে ২০২২ সালের জুন মাসে। এটি পরবর্তী বছরগুলোয় দুই মাস করে এগিয়ে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত রুটিনে ফেরত যাবে। এইচএসসিরও জন্য অনুরূপ সময় নির্ধারণ করতে হবে।

কারিকুলামের সর্পিল যোগ্যতাগুলো অর্জন করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করারও দরকার হবে। এর উদ্দেশ্য হবে কী করে ১৮ মাসের অ-অধীত বিষয়গুলোকে নতুন বিষয়ের সঙ্গে সমন্বিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে আনন্দ ও খেলার মাধ্যমে যেন শিখনফল অর্জিত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, স্কুলে যাওয়া একটি অভ্যাসের বিষয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সেটি নষ্ট হয়ে গেছে এবং ২০২০ ও ২০২১ সালে শিক্ষাজীবন শুরু করা প্রায় ৭০ লাখ ছেলেমেয়ের কিন্তু এ অভ্যাস গড়েই ওঠেনি। সম্প্রতি ইএমকে সেন্টারের সহযোগিতায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির একটি গণগবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করার এ কাজ অনলাইনে সম্পন্ন করা যেতে পারে।

দীর্ঘ ১৮ মাস পর আমাদের নতুন প্রজন্ম আবারও হাসি-আনন্দে স্কুলে ফেরত যাচ্ছে। নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে আমরা যাতে তাদের এই ফেরাকে শিক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য অর্থবহ করে তুলতে পারি, সেটিই যেন আমাদের লক্ষ্য হয়।

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টের প্রধান।