১৯টা উট দুই ভাগ করতে পারেন যিনি

ভারতের রাজস্থানে এক লোকের ১৯টা উট ছিল। তিনি মৃত্যুর আগে একটা উইল করে যান। অর্ধেকসংখ্যক উট পাবে তাঁর ছেলে। চার ভাগের এক ভাগ পাবে মেয়ে। আর পাঁচ ভাগের এক ভাগ পাবে তাদের রাখাল।

গ্রামের লোকেরা চিন্তায় পড়ে গেল। ১৯টা উট দুই ভাগ করা যাবে কী করে? (বলে রাখছি, এই গল্প আমি পেয়েছি অনলাইনে। এটা আমার রচিত নয়। আমি ব্যাপারটা কষ্ট করে টাইপ করে আপনাদের সামনে নিজের ভাষায় প্রকাশ করছি মাত্র। একটু টীকা-টিপ্পনী দিয়ে দেব।)

আচ্ছা। একটা উট জবাই করে তার মাংস দুই ভাগ করে দেওয়া যায়। তা না হয় হলো! ছেলে পেল ৯টা আর কিছু মাংস। এরপর মেয়ে পাবে তার অর্ধেক। মানে সাড়ে চারটা। আবার একটা উট কাটতে হবে। তারপর?

তারা যতই ভাবে, ততই তাদের মাথায় জট পাকাতে থাকে।

ওই গ্রামটা বাংলাদেশের কোভিডকালের জনপদ নয় যে এলাকায় চাল যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে কোভিড–১৯ পজিটিভ ১০৯ জন আর চালচোর পজিটিভ ৪০৩ জন শনাক্ত হবে। তাদের এলাকায় একজন জ্ঞানী সজ্জন ‌ব্যক্তি ছিলেন। গ্রামবাসী জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে গেল। তিনি তখন সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান দিলেন।

তিনি নিজে একটা উট যোগ করে দিলেন এই মৃত লোকের উটের সঙ্গে। হলো কুড়িটা উট। অর্ধেক পাবে ছেলে। ছেলেকে দিলেন ১০টা। তার অর্ধেক পাবে মেয়ে। মেয়েকে দিলেন ৫টা। আর পাঁচ ভাগের একটা পাবে রাখাল। তাকে দিলেন ৪টা। হলো ১৯টা। এবার তিনি নিজের উট নিজে নিয়ে উটে চড়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বক্তৃতা খুবই রসাল হয়ে থাকে। তাঁর একটা গল্প: তাঁরা যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন, তখন তাঁর মামাও তাঁদের সঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তাঁরা একই বয়সী। সবাই পাস করল। মামা ফেল করলেন। মামা তখন অন্যের আনন্দকে নিজের আনন্দে পরিণত করার চেষ্টা করলেন। তিনি মিষ্টি কিনলেন প্রচুর। যারা পাস করেছে, তাদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি দিয়ে এলেন। আজ ৬০ বছর পর সবার মনে আছে সেই মামার কথা, কিন্তু যারা পাস করল, তাদের কথা কারও মনে নেই। যে দেয়, তাকেই মানুষ মনে রাখে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, যিনি দেন, তিনি দেওতা। দেবতা। আর যিনি নেন, তিনি নেওতা। নেতা।

আমাদের আগের কালের নেতারা দিতে জানতেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব দিতেন, বঙ্গবন্ধুর বইয়ে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। শেরেবাংলা দিতেন। মাওলানা ভাসানী দিতেন। আর দিতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় অভাবের সময় নিজের গোলা থেকে চাল দিয়েছেন, বস্ত্রহীন বালককে বস্ত্র দান করেছেন ছোটবেলাতেই, কলকাতায় পথের ধারে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, নিজের জীবনটাই তিনি দান করে গেছেন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য।

তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তর সালে এক জামা নিজে ধুয়ে দিয়ে বাতাসে শুকিয়ে পরতেন। আমাদের বামপন্থী আদর্শবাদী নেতারা একসময় জমিদার বাবার আশ্রয় ছেড়ে এক বস্ত্রে দিনের পর দিন কাটিয়ে জেল-জুলুম, শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে নিঃস্ব হয়ে জীবন দিয়েছেন।

আর এখনকার অনেক নেতাই নেওতা। কী পেলাম? দ্যান। আরও দ্যান। মূল্যায়ন করেন। প্লট দ্যান। বিনা শুল্কের গাড়ি দ্যান। এলাকা ধরে নগদ বরাদ্দ দ্যান। তাতেও না কুলালে মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারের ব্যবসা করব, ছায়া দ্যান।

আজকাল আবার কৌতুকও পরিবেশন করা যায় না। এই উট ভাগের কৌতুকটা যদি ফেসবুকে দিই, যেসব কমেন্ট আসতে পারে:

১. অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।

২. আপনি নিজে একটা উট দিয়ে দিলেন না কেন?

৩. মেয়ে কেন ছেলের অর্ধেক পাবে?

৪. রাখালকে চারটা উট কেন দেবেন? আপনার আছে, আপনি দিতে পারেন, কিন্তু বাজার খারাপ করেন কেন?

৫. লোকটার স্ত্রী সম্পর্কে তো কিছুই জানা গেল না?

৬. আপনি কিছুই লিখতে জানেন না। কারণ, আপনারা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করেন। আসলে ওই লোক মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি গিয়ে সব কটি উট নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। মৃতের পরিবার এখন এলাকাছাড়া। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরছে: উট চাই না, ভিটামাটি ফেরত চাই।

৭. সম্প্রতি একটা পোস্টের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এই পোস্টটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক এবং ভাবমূর্তি বিনষ্টের ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, রাজবাড়ী এলাকায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে নাই। এই পোস্টদাতার বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা করা হবে।

৭. অ্যাড মি অ্যাড মি অ্যাড মি।

লেখাটার শিরোনাম দিয়েছিলাম: ১৯টা উট দুই ভাগ করতে পারেন যিনি। এই নিয়ে একটা কথা বলে শেষ করি: যিনি সমস্যার সমাধানে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারেন, নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যান, মানুষ যাঁর কথা শোনে, যাঁর ওপরে নির্ভর করে, যাঁর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়, তিনিই নেতা।

এর বিপরীতে আছে বানরের পিঠা ভাগের গল্প। ভাগ করতে গিয়ে যে অন্যের পিঠার পুরোটা খেয়ে ফেলে, সে নর নয়, সে বানর।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক