৩০০ কোটি মানুষ ঠিক খাবার পায় না, সমাধান কী

ছবি: এএফপি

খাদ্যশস্য, দুধ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার জন্য কোভিড-১৯ মহামারিকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ মহামারি আসার আগেও সারা পৃথিবীতে ৩০০ কোটি মানুষ সবচেয়ে সস্তা স্বাস্থ্যকর খাবারও কিনে খেতে পারত না।

বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের ওপর সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং উপার্জন কমে যাওয়ায় নিম্নমানের খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে। ওই বিশ্লেষণ বলছে, ২০১৭ সালেও ঠিক এ পরিমাণ লোক টাকার অভাবে নিম্নমানের খাবার খেয়ে দিন কাটাত। স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার কেনার সক্ষমতা যখন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন রক্তশূন্যতা ও ডায়াবেটিসের মতো অপুষ্টিজনিত ও খাদ্যগ্রহণসংক্রান্ত রোগব্যাধির ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশ্লেষণ বলছে, বিশ্বের মোট ৭৯০ কোটি মানুষের বাকি ৬০ শতাংশ লোক স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য রাখে। এর মানে এই নয় যে তারা সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকে। রান্নার সময় বের করা ও ঘরোয়া নানা জটিলতার কারণে এবং বিজ্ঞাপনসর্বস্ব মার্কেটিংয়ের ফাঁদে পড়ে তারা পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করে এমন খাবার খেয়ে থাকে, যা ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর।

একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি অনুসরণ করে ম্যাসাচুসেটসের টাফটস ইউনিভার্সিটিতে আমরা ‘ফুড প্রাইসেস ফর নিউট্রিশন’ শীর্ষক একটি গবেষণা চালাচ্ছি। সে গবেষণায় স্বাস্থ্যকর খাবারের দুষ্প্রাপ্যতার পেছনে সামর্থ্যহীনতাসহ অন্য কী কী কারণ রয়েছে, তা আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ডেটা গ্রুপ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিচালিত এ প্রকল্পে কীভাবে মানবস্বাস্থ্যের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে কৃষি ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাসম্পর্কিত, তা দেখানো হয়েছে।

স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার কেনার সক্ষমতা যখন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন রক্তশূন্যতা ও ডায়াবেটিসের মতো অপুষ্টিজনিত ও খাদ্যগ্রহণসংক্রান্ত রোগব্যাধির ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

বৈশ্বিকভাবে খাবারের দরদাম কত, তা বোঝার জন্য আমাদের প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত ভিত্তিতে উল্লেখিত ১৭৪টি দেশের প্রায় ৮০০ পদের জনপ্রিয় খাবারের মূল্যসংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোন খাবারের পুষ্টিগুণ কতটা, তা আমরা পরিমাপ করেছি। প্রতিটি খাবারের দাম এবং সেসব খাবারের পুষ্টিগুণ কেমন, তা নথিবদ্ধ করেছি। এরপর কোন খাবার অর্থমূল্যের দিক থেকে এবং কোন খাবার পুষ্টিমানের দিক থেকে মূল্যবান, তা শনাক্ত করেছি। এর মধ্য দিয়ে কোন কোন শ্রেণির মানুষ অর্থাভাবে স্বাস্থ্যকর খাবার পায় না, আর কোন শ্রেণির মানুষ আর্থিক কারণের বাইরের কোন কোন কারণে পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।

তথ্য–উপাত্ত থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেকেই ভাতসহ চালজাত অন্যান্য খাবার, শিমজাতীয় সবজি, হিমায়িত শাক, কৌটাজাত টুনা মাছ, রুটি, মাখন ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে কেনার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ মানুষ এসব পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে কেনার সামর্থ্য রাখে না। এমনকি তাদের সারা মাসের আয়ের সবটাও যদি এসব দামি খাবার কেনার পেছনে ব্যয় করতে চায়, তাহলেও তারা তা কিনতে পারবে না।

খাবারের দামে বরাবরই বাড়া-কমা আছে। কিন্তু ফল, সবজি, বাদাম, দুগ্ধজাত খাবার ও মাছের মতো খাবারের দাম তেল, চিনির মতো খাদ্যদ্রব্যের চেয়ে বরাবরই অনেক বেশি। পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবারের উচ্চমূল্য গরিব মানুষকে সেসবের স্বাদ আস্বাদন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে, অনেকে ক্ষুধার্ত থাকতে বাধ্য হয়।

এ অবস্থায় কী করণীয় আছে? সরকারগুলো অধিকতর উচ্চ বেতনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষাবলয় বিস্তৃত করে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্যকর খাবারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (সংক্ষেপে ‘স্ন্যাপ’) নামের একটি প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের আমেরিকানদের প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে সহায়তা দেওয়া হয়। এ ধরনের সুরক্ষা জাল খাদ্য অনিরাপত্তার মাত্রা কমিয়ে আনে, মন্দার সময় কর্মসংস্থানকে রক্ষা করে এবং বিশেষত শিশুদের সুষম বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কর্মীদের বেতন বাড়ানো এবং খাদ্য সুরক্ষা জাল জারি রাখা ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থার উন্নতিকল্পে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতে সরকার বিনিয়োগ করে খাবারের দাম কমাতে পারে। কৃষিভিত্তিক অভিনবত্ব ও খাদ্যবাজারে বিনিয়োগ একদিকে বহু লোকের জীবন বাঁচাবে, অন্যদিকে তা অর্থনীতিতে গতি আনবে। আমরা বিশ্বাস করি, বৈশ্বিক কৃষিনীতিগুলোর জন্য সহায়ক তথ্য সরবরাহে আমাদের জোগাড় করা খাদ্যসংক্রান্ত খরচের উপাত্ত মানুষকে বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেবে। এ উপাত্তের আলোকে সরকারগুলো যদি আন্তরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত


উইলিয়াম এ মাস্টার্স ম্যাসাচুসেটসের টাফটস ইউনিভার্সিটির ফুড ইকোনমিকসের অধ্যাপক এবং

আন্না হারফোর্থ টাফটস ইউনিভার্সিটির ফুড প্রাইসেস ফর নিউট্রিশন প্রজেক্টের উপপরিচালক