৪২ বিশিষ্ট নাগরিকও বিএনপির দালাল!


নির্বাচনসংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের একটি হলো আর্থিক অনিয়ম অপরটি হলো জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অসদাচরণ।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা যদি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা অভিশংসনের বিধান আছে। ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে সে কথাই বলেছেন। এর বিকল্প  রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা। অতীতে কোনো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিশংসন হয়নি। তবে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এম এ আজিজ কমিশন এবং এম এ সাদেক কমিশন। তাদের জনসমক্ষে নাকাল হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। অভিশংসন তার চেয়ে সম্মানজনক। নিয়েছে। ৪২ নাগরিক  যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা ঘরে-বাইরে, অফিসে-আড্ডায় সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। সেই অর্থে তাঁরা নতুন কিছু বলেননি।

অতীতে কোনো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিশংসন হয়নি। তবে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এম এ আজিজ কমিশন এবং এম এ সাদেক কমিশন। তাদের জনসমক্ষে নাকাল হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। অভিশংসন তার চেয়ে সম্মানজনক।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে আছে, ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম; নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগপ্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম; নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম; ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।’
বিশিষ্ট নাগরিকেরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, সে বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া, ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দেননি। কেবল একজন কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এটি তাঁরা (বিশিষ্ট নাগরিকেরা) উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু চিঠির খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত তিনজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা ত্বরিত জবাব দিয়েছেন।

তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিবৃতিদাতা ৪২ বিশিষ্ট ব্যক্তির সবাই বিএনপি ঘরানার হিসেবে পরিচিত। তাঁদের কেউ কেউ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদেও আছেন এবং তাঁরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বলে আসছেন। বিবৃতিটা বিএনপি অফিস থেকে ড্রাফট করে দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বিবৃতিদাতাদের নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেছেন, নানা অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগ এনে মূলত বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের এই চেষ্টা হালে পানি পাবে না।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন, জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অনেক সময় তাঁরা নীরব থাকেন। এই কয়েক দিন আগেই জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। সে ব্যাপারে কিন্তু তাঁরা কোনো বক্তব্য দেননি। যখন দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য হেফাজত বা ধর্মান্ধরা কাজ করছে, তখন নতুন একটা উপাদান আনা হলো এই বিবৃতি দিয়ে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে।

৪২ বিশিষ্ট নাগরিক বলেছেন, কমিশন যে অন্যায় করেছে, তা অভিশংসনযোগ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি তাঁদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। তদন্তে যদি দেখা যায় তাঁরা নির্দোষ, তাহলে তাঁরা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। আর তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের অভিশংসন করবেন।

উদ্দেশ্য যে আছে, তা চিঠিদাতারা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন এবং প্রতিকার চেয়েছেন। যে বিশিষ্ট নাগরিকেরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, তাঁদের পরিচয়টা একবার দেখে নিতে পারি। তাঁরা হলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত মহাহিসাব নিরীক্ষক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি আর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

এই তালিকার কারও কারও সঙ্গে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ মহলে যোগাযোগ থাকলেও বেশির ভাগ দলীয় বৃত্তের বাইরের মানুষ। স্বাধীন চিন্তার মানুষ। তারা সব সময় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কথা বলেন। বিএনপির আমলে তাঁরা যখন এসব নিয়ে কথা বলেছেন, তখন আওয়ামী লীগ নেতারা বাহবা দিয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগ আমলে একই কথা বললে তারা বেজার হয় এবং বিএনপি খুশি হয়।
কিন্তু নির্বাচন, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার এ রকম নয় যে বিএনপির আমলে সংজ্ঞা এক রকম হবে, আওয়ামী লীগ আমলে আরেক রকম। আওয়ামী লীগই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করেছে। এখন সেই নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বললে যদি বিএনপির দালাল হয়ে যায়, তাহলে এসবের সংজ্ঞাও বদলে দিতে হয়। তাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা এক সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকে বিএনপি-জামায়াত প্রশ্নে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের চেয়েও আপসহীন। তাই এ কথা বলার উপায় নেই যে তাঁরা বিএনপির দালাল।

আওয়ামী লীগের সমর্থক অনেক বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ হঠাৎ ৪২ জন বুদ্ধিজীবী কেন রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখলেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, যেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অস্তিত্ব নেই, সেখানে রাষ্ট্রপতির কাছে এই আবেদন অর্থহীন।
কিন্তু তাঁরা কেউ বলেননি যে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অসত্য ও ভিত্তিহীন। ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক বলেছেন, কমিশন যে অন্যায় করেছে, তা অভিশংসনযোগ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি তাঁদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। তদন্তে যদি দেখা যায় তাঁরা নির্দোষ, তাহলে তাঁরা নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন। আর তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের অভিশংসন করবেন। তাঁরা বলেননি যে চিঠি পাওয়ার পরপরই তাঁদের নির্বাচন কমিশন থেকে বের করে দেওয়া হোক।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কিছুটা (যেমন আর্থিক অনিয়ম) অদৃশ্য হলেও বাকিটা দৃশ্যমান। যেমন নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম। দেশের গণমাধ্যম অনিয়মের খবর প্রকাশ করতে না পারলেও বিদেশের গণমাধ্যম কিছু কিছু করেছে। টিআইবির অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে। নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দলটি এগুলো কীভাবে অস্বীকার করবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি