৪৬ বছর আগের সেই ‘কষ্ট-সকাল’

আম্মা ফজরের নামাজ পড়েই আব্বার জন্য নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত হলেন। আব্বা আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ডিউটিতে থাকবেন। আব্বা তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় নিহত জগন্নাথ হলের ছাত্র–শিক্ষক–কর্মচারীদের শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু আসবেন হল চত্বরে। আব্বার ডিউটি আজ সেখানেই।

সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ বাসা থেকে ডিউটিতে বেরিয়ে যেতেই ৭টায় বাংলাদেশ বেতারের খবর শুনতে মা রেডিও অন করলেন। ৭টার খবর তখনো ঢের বাকি। ছোটবেলা থেকেই আব্বার ওই ‘মারফি’ রেডিওতে খবর শোনে বড় হয়েছি। আজ আব্বা বাসায় না থাকলেও অভ্যাসমতো খবর শুনতে মা রেডিও অন করতেই চমকে উঠলাম আমরা। চড়া আর বেসুরো গলায় এক মেজরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি!... শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ আম্মা চিৎকার করে উঠলেন। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে রেডিওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ততক্ষণে বড় বোন পারভিন বুবু আর ছোট বোন নিনা তাদের ঘর থেকে ছুটে এসেছে। আমরা তিন ভাইবোন আর আম্মা হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকি রেডিওটির দিকে।

আমার মাথায় ঢোকে না কোনো কিছু। আমি চিৎকার করে উঠি, ‘আম্মা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে।’ ডুকরে কেঁদে উঠি আমি। কাঁপা হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে আমি শেখ কামাল ভাইয়ের নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে ফোন নম্বরটা মনে করতে পারি না। এত দিনের চেনা নম্বরটা মনেই আসে না। আমি কাঁপা হাতে নোট বই থেকে নম্বরটা দেখে দেখে ডায়াল ঘুরাতেই রিং বেজে উঠল, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তিনতালায় কামাল ভাইয়ের রুমে রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে। টানা বেজে চলেছে ফোন, কিন্তু কেউ ধরছে না। আমি লাইন কেটে আবার ঘুরাতে থাকি। নাহ্‌, এবারও কেউ ফোন ধরল না। আমি নিচতলায় রিসেপশনে ডায়াল করি, এবারও তা–ই। রিং বেজেই চলেছে, কেউ রিসিভার তুলছে না।

তাহলে কি ঘটনা সত্যি? আমি ভীত হয়ে পড়ি। কান্না করতে থাকি। ঘটনাটা সত্যি কি না, জানার জন্য কাকে ফোন করব, কোথায় ফোন করি। আমার বাচ্চু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। বাচ্চু ভাই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা টিমের একজন সদস্য। আমি তাঁর শংকরের বাসায় ফোন করতে থাকি। ফোনে রিং বাজতে থাকে, বেশ কিছুক্ষণ রিংয়ের পর কেউ একজন ফোনটা কানে ধরে চুপ করে থাকে, কোনো কথা বলে না। আমি অস্থির হয়ে হ্যালো হ্যালো বলতে থাকি। কোনো সাড়া না পেয়ে আমি আমার নাম বলতে থাকি, পরিচয় দিতেই বাচ্চু ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এল। ‘হ্যাঁ পাভেল বলো?’ স্বাভাবিক কণ্ঠ ভেসে আসে বাচ্চু ভাইয়ের প্রান্ত থেকে। আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলি, ‘রেডিওতে কী সব শুনছি বাচ্চু ভাই?’ বাচ্চু ভাই তেমনই শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যা শুনেছ, সবই সত্যি শুনছ!’ আমি তাঁর কণ্ঠে ‘সত্যি’ কথাটা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। ছোট্ট রাসেলের মায়াভরা মুখটা ভেসে ওঠে, আমি কাঁদতে কাঁদতে রাসেলের কথা জানতে চাইলাম, ‘বাচ্চু ভাই, রাসেল কোথায়?’ বাচ্চু ভাই বললেন, ‘ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে, রাসেলও বেঁচে নেই। শোনো পাভেল, আমরা বাসা থেকে সরে যাচ্ছি, তুমিও বাসায় থেকো না, বেরিয়ে যাও।’

কথা শেষ না হতেই আকস্মিক ফোন ছেড়ে দিলেন বাচ্চু ভাই। বাচ্চু ভাইয়ের কাছে ‘সত্যি’ কথাটি শুনে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। কী করব বুঝতে পারি না। ‘আম্মা, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে আম্মা’, বলে আমি কান্না করতে থাকি। আম্মা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আহ্‌, রাসেল, এতটুকু বাচ্চা মানুষ, আহ্‌, ওকেও মেরে ফেলেছে!’

আমি বেরিয়ে পড়ি বাসা থেকে। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর বেবি আইসক্রিম মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। বেশ কিছু মানুষের জটলা। বাঁ দিকে নিউমার্কেটের রাস্তা, ডানে লালবাগের রাস্তা পুরোটাই ফাঁকা। একটা রিকশা পর্যন্ত নেই। জটলার লোকগুলো সোজা পলাশীর দিকে তাকিয়ে…। আমি বললাম, ‘কী দেখছেন আপনারা।’ একটা লোক বললেন, ‘শুনলাম ঢাকা মেডিকেলে অনেক লাশ এসেছে!’ আমি হকচকিয়ে যাই, ‘কাদের লাশ?’ লোকটা নির্বিকার পলাশীর পথে তাকিয়ে ভাবলেশহীন বলে ওঠেন, ‘শুনতাসি শেখ মনির পরিবার আর মন্ত্রী সেরনিয়াবাতের পরিবারের মেলা লাশ আনছে মর্গে।’

আমি তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁটতে থাকি পলাশীর দিকে। আজিমপুর মোড় ক্রস করতে গিয়েই থমকে দাঁড়াই! মাত্র কিছুদিন আগে শেখ কামাল ভাইয়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে, পুলিশ সার্জেন্ট কামাল ভাইয়ের গাড়ি আটকিয়ে সার্চ করল। আমাকে কামাল ভাই বাসায় নামাতে আসছিলেন। সার্জেন্টের গাড়ি চেকের সামনে টু শব্দটি না করে নেমে এলেন তিনি আর আমাদের নামতে বললেন গাড়ি থেকে।

পলাশীর দিকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকি আমি। বঙ্গবন্ধু আমার মনের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে। রাস্তায় কোনো লোক নেই প্রতিবাদের। জগন্নাথ হল পেরোতেই এগিয়ে আসে শহীদ মিনার। আমাদের প্রতিবাদী হতে শেখাল যে শহীদ মিনার। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে একাকী! শহীদ মিনার লাগোয়া ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেট। গেটে জনাবিশেক উৎসুক লোক ভিড় করে আছে। আর ৫–৬ জন রাইফেলধারী পুলিশ ভিড় করতে মানা করছে গেটের সামনে।

উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন সদ্য চুন করা অ্যানেক্স বিল্ডিং একাকী দাঁড়িয়ে। একটা কাকপক্ষী নেই কোথাও। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। হেঁটে চলে আসি টিএসসিতে। এদিক-ওদিক বিচ্ছিন্ন কজন ছাত্র জটলা করে। আমি শাহবাগ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরি। নির্জন রোডে কাউকে তেমন ভিড়–জটলা করতেও দেখি না। মাঝেমধ্যে হুটহাট সুনসান ছুটে চলে পুলিশের গাড়ি।

সায়েন্স ল্যাবের কোণে দেখি, কিছু উৎসুক মানুষ তাকিয়ে থাকে ধানমন্ডির দিকে। ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোড আর গ্রিন রোডের মুখে পেট্রলপাম্পের কোণে কিছু সেনা তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। দূর থেকে আমাদের দিকে মেগা মাইকে সতর্ক করে সরে যেতে নির্দেশ করে।

আমি আবার হেঁটে হেঁটে নিউমার্কেট ক্রস করে আজিমপুর কলোনির বাসায় ফিরে আসি। পুরো এলাকা যেন থমকে গেছে!
মনে হয় পুরো দেশটাই বুঝি থমকে গেছে…।

পাভেল রহমান একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটোসাংবাদিক