৫০ বছর পর চিলির জনতার প্রতিশোধ

গণভোটে জনতার বিজয়ে উল্লাস
রয়টার্স

চিলির জনগণ ৫০ বছর পরে প্রতিশোধ নিল। গণভোটে সামরিক স্বৈরাচারী পিনোশের সংবিধান বাতিল হয়ে গেল। পিনোশের প্রেতাত্মা থেকে চিলি মুক্তি পেতে শুরু করেছে।
দক্ষিণ আমেরিকা একের পর এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে চলেছে। বলিভিয়ার পর নতুন চমক চিলি। চিলির জনসাধারণ গণভোটে ফ্যাসিস্ট শাসক জেনারেল আগুস্তো পিনোশের সংবিধান বাতিল করে দিয়েছেন। কিছু দিন আগেই বলিভিয়ার ভোটে সাবেক রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেসের সমর্থকেরা পশ্চিমাপন্থীদের নাস্তানাবুদ করেছে। ইভো মোরালেসকে এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বিরোধীরা ক্ষমতাচ্যুত করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। চিলি ও বলিভিয়ার ভোট—দুটিতেই জনসাধারণের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ জয়ী হয়েছে।

গণভোটের মাধ্যম চিলির জনগণ নতুন সংবিধান তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখবেন। এখানে শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকা হবে সংবিধান প্রণয়নে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল। সাধারণত সরকারি দল বা পার্লামেন্ট সংবিধান প্রণয়ন করে। কখনো কখনো সংবিধান তৈরি করে অনুমোদনের জন্য গণভোটে দেওয়া হয়। এটাও নামকাওয়াস্তে করা হয়। কারণ, ওই সব সংবিধানে জনমতের পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটে না। এবার চিলিতে ভিন্নভাবে নতুন সংবিধান রচিত হবে। রোববারের গণভোটে ৭৮ শতাংশ ভোটার নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এর পাশাপাশি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠনের জন্যও ভোটে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দুই মাসের মধ্যে চিলির রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জন্য সদস্যদের মনোনয়ন করবে। মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে আগামী বছরের এপ্রিলে ১৫৫ জন সদস্যকে নির্বাচিত করবেন জনসাধারণ। সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে লৈঙ্গিক সমতা বজায় রাখা হবে। কমিটি ২০২২ সালের মধ্যে সংবিধান চূড়ান্ত করে আবারও গণভোটের আয়োজন করবে। ওই গণভোটে জনসাধারণ সিদ্ধান্ত নেবেন, নতুন সংবিধান আদৌ গ্রহণযোগ্য কি না। যদি দুই–তৃতীয়াংশ ভোট সংবিধানের পক্ষে না যায়, তবে আবার সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন করা হবে। দেখা যাচ্ছে, সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনদের কোনো ভূমিকা থাকবে না বা যেনতেন প্রকারে সংবিধান চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না।

কয়েক বছর ধরেই চিলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। তবে মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্বসহ নানা সংকট নিরসনের জন্য গত বছরের অক্টোবরে গণ–আন্দোলন শুরু হয়। অসমতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলনকারীরা পিনোশের আমলের সংবিধান বাতিলের ডাক দেন। কারণ, চিলির নাগরিকেরা মনে করে, পিনোশের শাসনামল এক নিষ্ঠুর রক্তাক্ত ইতিহাস। প্রতিবাদী জনসাধারণকে গুম করে দেওয়ার এক নৃশংস সময়। এহেন দুঃশাসকের তৈরি করা সংবিধান মোতাবেক দেশ চলতে পারে না। জনগণের অধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছিল পিনোশের সংবিধানে।
আন্দোলনের তীব্র চাপে গত নভেম্বরে দেশটির রাষ্ট্রপতি সেবাস্টিয়ান পিনেরা গণভোটের ঘোষণা দেন।

উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে পিনোশে নতুন সংবিধান রচনা করেন। এতে গুরুত্ব পায় আমেরিকার আগ্রাসী পুঁজিবাদী নীতির প্রবক্তা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের নির্দেশনা। চিলিতে তাঁদের অনুসারীদেরই বলা হয় শিকাগো বয়েজ—রক্ষণশীল মতাদর্শের অনুসারী। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রাজনীতির ওপর কঠোরতা আরোপ করে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া। এতে করে বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটতে থাকে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকীকরণ ঘটে। এর পাশাপাশি বিদেশি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো চিলির বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়।

এবারের এই গণভোটের তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য আমাদের একটু গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এটা নেহাতই কোনো সাধারণ গণভোট না। এই গণভোটের পেছনে অনেক মানুষের জীবন, রক্ত, গুম হওয়া জড়িত। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে চিলির নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

এবারের এই গণভোটের তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য আমাদের একটু গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এটা নেহাতই কোনো সাধারণ গণভোট না। এই গণভোটের পেছনে অনেক মানুষের জীবন, রক্ত, গুম হওয়া জড়িত। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে চিলির নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। নির্বাচিত শাসক সালভেদর আয়েন্দকে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে হত্যা করে সামরিক শাসক আগুস্তো পিনোশে ক্ষমতা দখল করেন।

গুম, নির্যাতন, দমনের কারণে পিনোশের আমলে এক গভীর অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে চিলি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে জানিয়েছে, পিনোশের আমলে তিন হাজারের বেশির মানুষ রাজনৈতিক হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। এখনো চিলি সরকার জানে না এর মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার মানুষের কী পরিণতি হয়েছিল। চিলির ন্যাশনাল কমিশন অব পলিটিক্যাল ইমপ্রিজনমেন্ট অ্যান্ড টর্চারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পিনোশের আমলে ৩৫ হাজার মানুষকে হত্যা, গুম ও নির্যাতন করা হয়।

চিলিতে ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নিখোঁজ হওয়া মানুষের অনুসন্ধান শুরু হয়। ওই সময় ১ হাজার ১৩৪টি নিখোঁজের মামলা করা হয়। গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আড়াই হাজারের বেশি মানুষকে সাজা দেওয়া হয়। পিনোশেকেও বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই পিনোশেকে রক্ষায় উদ্যোগী ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত পিনোশেকে ২০০৪ সালে বিচারের মুখোমুখি করা হলেও বিচার শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন চিলি পিনোশের সংবিধান বাতিল করে নতুন দিন শুরুর অপেক্ষায় আছে। তবে পরিস্থিতি চিলির জনসাধারণের অনুকূলে ছিল না।

কারণ, বৈশ্বিক রাজনীতির ভাবগতি খুব বেশি সুবিধার নয়। দেশে দেশে গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরে ছদ্ম ফ্যাসিবাদীরা শাসনক্ষমতা দখল করে আছেন বিভিন্ন উপায়ে। বিভিন্ন দেশে হুটহাট গুম হয়ে যাচ্ছেন নাগরিকেরা। স্বাভাবিক রাজনীতির পরিবেশ নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই অথবা সরকারপন্থীরা গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিরপেক্ষতার ভান ধরেছে। গণভোটের পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে অনেক দেশে। ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, এটাই নাকি জনগণ চেয়েছিল।
এসব দেশের জনসাধারণের জন্য চিলি এক অনন্য উদাহরণ। গণতন্ত্রের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে স্বৈরতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু উপড়ে ফেলতে হয়, তার কার্যকর নজির চিলির গণভোট। চিলির নতুন সংবিধানের সঙ্গে লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস, রক্ত, জীবন, হাহাকার মিশে আছে। আটলান্টিকের বাতাসে এখনো ভেসে বেড়ায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের আর্তনাদ। চিলি জেগে উঠছে একটু একটু করে। সর্বোপরি চিলির নতুন সংবিধান হবে আয়েন্দের নির্মম হত্যার এক চরম প্রতিবাদ।

সংবিধান, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা—কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যুগে যুগে এসবের পরিবর্তন হয়। চিলিও এক পরিবর্তনের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত চিলি যদি গণবান্ধব সংবিধান রচনা করতে পারে, তবে তা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। অনেক দেশেই সংবিধানকে দুমড়েমুচড়ে ফেলা হয়েছে। গুম হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ওই সব দেশের জনসাধারণও গুম হয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে নামতে পারে চিলির ঘটনাবলি সামনে রেখে। জনসাধারণের যূথবদ্ধতাই ইতিহাসের নতুন বাঁকের সৃষ্টি করে।


মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক