৫০ বছরের বাংলাদেশ বনাম আগামীর বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ভালো করছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনেও প্রশংসনীয় অগ্রগতি। বিজয়ের ৫০ বছর আরও সুবর্ণ হয়ে উঠেছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির আন্তর্জাতিক এক স্বীকৃতির কারণে। গত নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি শ্রেণি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত।

গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। করোনার আগে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৭। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় প্রধানের মতে, স্বাধীনতা–পরবর্তীকালের বাংলাদেশের পরিচিতি ‘বাস্কেট কেস’ থেকে এখন দেশটি উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার, যা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। সর্বশেষ হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৪০৯ বিলিয়ন ডলার (৩৫ লাখ কোটি টাকার বেশি) ছাড়িয়েছে।

সামাজিক অগ্রগতিও হয়েছে ব্যাপক। গত ৩০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ১৫ বছর। পাকিস্তানে বেড়েছে মাত্র সাত বছর। বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ভারতে গড় আয়ু ৬৯ বছর। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৪। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ভর্তির হার বেড়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বয়স বিবেচনায় শিশুদের ৭৩ শতাংশ এখন স্কুলে যায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের হার ছিল ৮২। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০ দশমিক ৫। কোভিডের কারণে গত বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির বেশ কিছুটা অবনতি হলেও সাম্প্রতিক কিছু জরিপ বলছে, তার অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধারের পথে।

স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ দশকের মধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছে। এতে বেসরকারি খাত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮১ সালে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। পুরো শিল্প খাতের অংশ জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ। এ সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এনেছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এখন বছরে রপ্তানি হয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলা। প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী করণীয়, তা নিয়ে ত্বরিত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নে ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন।

দেশ স্বাধীনের পর প্রথম অগ্রাধিকার ছিল কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার ছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। আশির দশকে তৈরি পোশাক খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। বাণিজ্যিক কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণে সেবা খাতের প্রসার ঘটে। নব্বইয়ের দশকে এসে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও টেলিকম খাতে নেওয়া নানা কর্মসূচি বাংলাদেশকে সামাজিক অগ্রগতিতে এগিয়ে নেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতিও আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়। স্বাধীনতার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত চার দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। গত ১০ বছরে তা ২০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। বাড়তি খরচ হলেও নিজেদের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ঢাকায় মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদনও শুরু হয়েছে।

গত বছর বিলাতের দ্য ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে বাংলাদেশ। এমডিজিতে দারিদ্র্যের হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি কমাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এমডিজি অর্জনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের লক্ষণীয় অগ্রগতি রয়েছে।

তবে উন্নয়নের নতুন স্তরে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার সুবিধা অনেক কমে যাবে। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের উত্তরণকালীন প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উত্তরণে এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তরণের শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। স্থানীয় বাজার ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি কমানো, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ অনেক বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার সুপারিশও উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়। বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে যেতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের জন্য ক্রমাগতভাবে কাজের ব্যবস্থা করা আগামী দিনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

সম্প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা বলে অভিহিত করেছেন অনেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। দেশে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে মানুষের মধ্যে বৈষম্য। কোনো দেশে বৈষম্য বেড়ে গেলে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারও বেড়ে যায়, সেটি অনেকেরই জানা। গত কয়েক দশকে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে সুশাসনকে পাশ কাটানো হয়েছে। এসব কারণে রানা প্লাজা, তাজরীন ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা ঘটেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় বেশ ধস নেমেছে।

গত ৪০ বছরে ওষুধ, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। তবে আমাদের রপ্তানি ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। করোনাকালে অনেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ গ্রামীণ অর্থনীতিতে কার্যক্রম টিকিয়ে রেখেছে। এতে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাঁরা সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন।

নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলা। প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী করণীয়, তা নিয়ে ত্বরিত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নে ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন। তার সঙ্গে উন্নয়নের সুফল যাতে বেশির ভাগ লোকের কাছে পৌঁছায়, সে ক্ষেত্রেও থাকতে হবে সদাতৎপর। তার সঙ্গে রয়েছে নজরদারি ও জনস্বার্থের দেখভাল করা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন। আধুনিক শিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাচেতনা, প্রযুক্তির ক্রমাগত ব্যবহার বৃদ্ধি এবং একটি পরমতসহিষ্ণু জাতি গঠনই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আগামী দিনের অগ্রযাত্রা।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক