'আড়ালে হাসেন বাবারা'

মাত্র কদিন আগে সারা দেশে এক ভয়ংকর দাবদাহ বয়ে গেল। মানুষ যখন শহরে গরমে হাঁসফাঁস করছিল, তখন আমি আমার ইউনিট নিয়ে পুবাইলের প্রত্যন্ত গ্রামে প্রকৃতি-বিষয়ক নাটকের শুটিং করছিলাম। তখনই মনে হচ্ছিল গ্রাম আসলেই কত সুন্দর, কতটা স্বস্তিদায়ক। কারণ, এত খরতাপের মধ্যেও একটা মৃদুমন্দ বাতাস শরীর-মনকে শীতল করে যাচ্ছিল। কখনো-বা কয়েক মুহূর্তের জন্য হাঁসফাঁস ভাবটা এলেও পরমুহূর্তে সেই মন ভোলানো বাতাসটা জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল প্রাণ।
বৈশাখ প্রায় শেষ হতে চলেছে। কয়েক দিন পরই খালবিলে চলে আসবে পানি। গ্রামগুলো পরিবর্তন করবে রূপ। মরা খালগুলোয় উল্টে পড়ে থাকা নৌকাগুলো চালু হয়ে আবার মুখর হয়ে উঠবে গ্রাম-জীবন।
এ চক্র শাশ্বত। চলছেই, চলবে। এতে হয়তো নতুনত্ব কিছুই নেই। তারপরও নতুন নতুন আশা নিয়ে মানুষ জেগে উঠবে প্রতিটি পরিচিত পরিবর্তনে।
সেদিন, এই গত ৩০ এপ্রিল পুবাইলের ‘চটের আগা’ গ্রামে আমবাগানের পাশে পুকুরপাড়ে বসে মনে পড়ছিল অনেক পুরোনো দিনের কথা। আমার বাবার কথা।
মরহুম মোহাম্মদ আবদুস সালাম, আমার বাবা ছিলেন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের পার্সোনেল ব্রাঞ্চের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। সেই ১৯৪৪ থেকে মৃত্যুর আগে (১৯৬৯) পর্যন্ত চট্টগ্রামে বসবাস করেছেন। নানা শখের মধ্যে দুটি বিশেষ শখ তাঁর ছিল—পাখি শিকার ও মাছ ধরা। এই দুই কারণেই প্রতি ছুটির দিন তাঁর বরাদ্দ থাকত গ্রামে যাওয়া—পটিয়া, ধলঘাট, হাটহাজারী, নয়তো দোহাজারী কিংবা নাসিরহাট।
ছোট্টবেলা থেকে বাবার সঙ্গী হতে ভালো লাগত আমার। পাখি ধরা কিংবা ছিপে মাছ উঠলে তা ছাড়ানো ইত্যাদি কাজে আমার উৎসাহ ছিল প্রচণ্ড। তখনকার কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। বাবা গাছের ছায়ায় বসে দেশের গল্প করতেন। গ্রামের বাড়ি, পুকুর, মাছ ধরা, পূজা, মহররম আরও সব উৎসবে তাঁর মাতামাতি নিয়ে বলতেন। দাদা ছিলেন পীর—তিনি অনেক সময় বাধা দিতে গিয়েও স্বস্নেহে বাবার অনেক কাজ মেনে নিতেন ইত্যাদি সব গল্প শোনাতেন। সেই মুর্শিদাবাদের গল্প।
জানি, এসব গল্প আপনাদের হয়তো ভালো লাগছে না। তারপরও বলি, আমি যে নাটকটা নির্মাণ করছিলাম পুবাইলে, তার নাম পাখির জন্যে ভালোবাসা। এক কন্যা, তার নাম পাখি। তার বাবাকে নিয়েই কাহিনি। এই বাবাটি যেমন নিজ কন্যা পাখির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, তেমনি প্রস্তুত সত্যিকারের পাখিকুলের জন্য প্রাণপাত করতে।
বাবারা এমনই। এমনই তো হবে বাবা। নিজ বক্ষ পেতে আগলে রাখবে সন্তান। শিক্ষা দেবে সন্তানকে জগতের যাবতীয় মঙ্গলকর বিষয়। গড়ে তুলবে নিজ ছায়ায় উন্নততর মানুষ হিসেবে। তারই অনুপ্রেরণায় সন্তান একদিন ছাড়িয়ে যাবে বাবাকে। সেখানেই হবে তার আনন্দ।

>সত্যিই তো আমরা বাবাদের জানি না। সন্তানরা ঘটনা ঘটিয়ে যায়, অথচ বাবাদের হদিস পাওয়া যায় না। সন্তানদের নিয়ে ধুন্ধুমার চলে, আড়ালে হাসেন বাবারা

কোথায় যেন পড়েছিলাম, আব্রাহাম লিংকন তাঁর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘বাবা, তুমি কী চাও, আমি বড় হলে কী হব?’
‘তোমার যা ইচ্ছা তা-ই হবে। তবে আমি চাই, তুমি যদি মাটি কাটার শ্রমিক হও, তোমার চেয়ে ভালো মাটি যেন কেউ কাটতে না পারে।’
না, আসলে লেখার কোনো বিষয় খুঁজে পাচ্ছি না। আপনারা বলবেন, চারদিকে এত ইস্যু ভেসে বেড়াচ্ছে আর তুমি বিষয় পাও না! আসলেই পাই না। ইস্যু তো খুঁজবেন রাজনীতিবিদ। আমার কাজ এন্টারটেইন করা।
বাবাকে নিয়ে কি এন্টারটেইন করা সম্ভব? ভাবছি। আচ্ছা, আমার নিজের একটা গল্প বলি। একটা অনুষ্ঠানে এক ভারতীয় বক্তা আমার নির্মিত নাটকের ওপর কথা বলতে গিয়ে আমার নাম বলেছিলেন ‘আবদুল হায়াত’।
তারপর আমার পালা এলে আমি বলেছিলাম, ‘ক্ষমা করবেন মি. অমুক, আমি জীবনের চাকর নই, জীবনের পিতা। কারণ, আবদ মানে চাকর আর আবু মানে বাবা। আমি আবু-আল-হায়াত। আব্দ আল হায়াত নই।’
ভদ্রলোক ভীষণ বিব্রত আর লজ্জিত হয়েছিলেন। সে জন্য আমি আবার হেসে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম তাঁর কাছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘আমার বাবা ব্যর্থ মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাবা।’
এক ভদ্রলোক বিদেশ থেকে তাঁর অতিবৃদ্ধ বাবাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান ফাদার্স ডের। তারপর তাঁর ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা, বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়ানো ইত্যাদি কথা বলেন। দুজনই অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে কান্নাকাটি করে বিদায় সম্ভাষণ জানান। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক যখন ফোনটি রাখতে যাবেন, বাবা বলেন, ‘তুমি কে, বাবা?’
এক ছাত্রের স্কুল যেতে মন চাইছে না। বাবার কণ্ঠ নকল করে হেডমাস্টারকে ফোনে বলছে, ‘ক্লাস ফাইভের আবুল হাসেমের খুব জ্বর, সে আজ স্কুলে যেতে পারবে না।’
হেডমাস্টার বলেন, ‘কে বলছেন প্লিজ?’
‘আমার আব্বা বলছি।’
আর এক ছেলের আইপ্যাড কেনার শখ। বাবাকে বলে ব্যর্থ হয়ে দাদির কাছে অভিযোগ জানায়। দাদি বলেন, ‘আল্লাহকে বল, তিনি নিশ্চয় দেবেন।’ তখন সেই ছেলে জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহ, তুমি আমাকে একটা আইপ্যাড দাও।’ তার চিৎকারে ছুটে আসেন দাদি: ‘এই বোকা, চিৎকার করিস না। আস্তে বললেও আল্লাহ শুনতে পান।’
ছেলের উত্তর, ‘আল্লাহ তো শুনতে পান, কিন্তু বাবা তো শুনতে পান না।’
স্কুলের শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে আছে এক শ টাকা, তোমার বাবা তোমাকে আরও এক শ টাকা দিলেন। তাহলে তোমার কত টাকা হলো?
ছাত্র বলে, ‘এক শ।’
শিক্ষক রেগে গিয়ে বলেন, ‘তুমি তো অঙ্কই জানো না!’
ছাত্র বলে, ‘আপনি তো আমার বাবাকেই জানেন না।’
সত্যিই তো আমরা বাবাদের জানি না। সন্তানেরা ঘটনা ঘটিয়ে যায়, অথচ বাবাদের হদিস পাওয়া যায় না। সন্তানদের নিয়ে ধুন্ধুমার চলে, আড়ালে হাসেন বাবারা।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।