'ইসলামি রাজনীতি' যেখানে থমকে আছে

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৯১-এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ১৮টি আসন পাওয়া। তারও আগে, ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের দ্বিতীয় স্থান লাভও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

হাফেজ্জী হুজুর এখন আর বেঁচে নেই। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীও এখন আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নেই।

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে ইসলামি ঘরানার দলগুলো এখনো পর্যন্ত যে তিনটি নির্বাচনী প্রতীক জনপ্রিয় করাতে পেরেছে, তার মধ্যে জামায়াতের ‘দাঁড়িপাল্লা’র সফলতাই বেশি। দাঁড়িপাল্লা প্রতীক এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় কোথাও দেখা যাবে না। সম্ভবত হাফেজ্জী হুজুরের ‘বটগাছ’ও নয়। তবে ইসলামী আন্দোলনের ‘হাতপাখা’ দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে ‘ইসলামপন্থী দল’ হিসেবে পরিচিত প্রায় ১০টি। দেশে প্রকাশ্য ইসলামি দলগুলোর সংখ্যা এর চেয়েও ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। ২০ নভেম্বর প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দাবি ছিল, কেবল ভোটের রাজনীতিতেই সক্রিয় আছে অন্তত ৭০টি ‘ইসলামি দল’। এর বাইরেও আছে অপ্রকাশ্য অনেক ইসলামি দল, যাদের সম্পর্কে স্বচ্ছ চিত্র পাওয়া দুরূহ।

প্রকাশ্য দলগুলো অন্তত তিনটি আদর্শিক ঘরানায় বিভক্ত এখন। এর মধ্যে জামায়াত হলো ইসলামি বা সংস্কারপন্থী ধারার সর্ববৃহৎ দল। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দেওবন্দী আদর্শের দলগুলো হলো দ্বিতীয় ধারা এবং আরও কয়েকটি গোষ্ঠী আছে রেজভী বা বেরলভী আদর্শের।

হাফেজ্জী হুজুরের পর
ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে অনেক লড়াই-সংগ্রামে মার খাওয়ার স্মৃতি নিয়েও দেওবন্দীরা এখনো খেলাফতের স্বপ্ন দেখেন। সেটা বিদ্যমান ‘রাষ্ট্র’ মেনেও! যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান নিয়ে গভীর অসন্তোষ আছে কওমি জগতে। বরাবরই ‘অনৈসলামিক সংস্কৃতি প্রতিরোধে’ এই ধারা যতটা মাঠে নামে, ইতিবাচক কোনো রাজনৈতিক কাঠামো আকারে ততটা হাজির নন তাঁরা।

অন্যদিকে, আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরই ইসলামি রাজনীতি করতে চাইছে জামায়াত। সর্বশেষ ১০ বছরে তারা নিবন্ধন, মার্কা ও নেতৃবৃন্দের অনেককে হারিয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে দলটি এবার নির্বাচন করছে ধানের শীষ প্রতীকে। তার নির্বাচনী ফলাফলের দিকে বিশেষ নজর রাখছেন দেশ-বিদেশের অনেক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক।

জামায়াতের তুলনায় কওমি ধারার দলগুলোর ওপর মনোযোগ রাখা দুরূহ। কারণ, কয়েক ডজন দল রয়েছে এই ‘ঐতিহ্যে’। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেওবন্দী-থানভি ধারার কাঠামোগত পুনরুজ্জীবন ঘটে লালবাগ মাদ্রাসায় মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের মাধ্যমে। ১৯৮৭ সালে হাফেজ্জী হুজুর মারা যাওয়ার পর তাঁর তিন শীর্ষ উত্তরাধিকারী ফজলুল হক আমিনী, আজিজুল হক এবং সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম (পরবর্তীকালে ‘পীর সাহেব চরমোনাই’) তিনটি দলের গোড়াপত্তন করেন। এর মধ্যে শেষোক্ত জনের উত্তরাধিকার হলো আজকের ইসলামী আন্দোলন-বাংলাদেশ। যার পূর্ব নাম ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। কওমি ঘরানার বড় দল এটা। তারা এবারও নির্বাচন করছে এককভাবে হাতপাখা প্রতীকে বর্তমান নেতা মাওলানা রেজাউল করীমের নেতৃত্বে।

ইসলামী আন্দোলনের একলা চলো নীতি কতটা ইসলামি রাজনীতির শক্তিভিত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আর কতটা নৌকাবিরোধী ভোট বিভক্ত করার লক্ষ্যে, তা নিয়ে আলেম-ওলামা জগতেই বিতর্ক-সন্দেহ-কাজিয়া আছে। এই অবিশ্বাসের কারণ, চলতি দশকে প্রায় সব বিরোধী দল ব্যাপক নিপীড়নের মুখে পড়লেও হাতপাখার সমর্থকেরা নির্বিঘ্নে দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ-ওয়াজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, যা বিস্ময়কর ও তাৎপর্যপূর্ণ। বরিশাল, ঝালকাঠি ও খুলনায় তিন অঞ্চলে ইসলামী আন্দোলন আসন্ন ভোটে মৃদু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারলেও কেউই মনে করছে না আসন্ন সংসদের কোনো আসনে বিজয়ী হবে এই দল। তবে প্রদত্ত ভোটের ৪ থেকে ৫ শতাংশ পাওয়ার নজির গড়তে পারে তারা।

হাফেজ্জী হুজুরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাগরেদ ফজলুল হক আমিনী ও মাওলানা আজিজুল হকের দলও এখন বিভক্তিতে অসংখ্য। এর প্রথমোক্ত সিলসিলা ধারণ করে আছে লালবাগকেন্দ্রিক ইসলামী ঐক্যজোট; নেতৃত্বে রয়েছেন আব্দুল লতিফ নেজামী। শেষোক্তদের মূল কেন্দ্র মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া, যাকে ‘বড় রাহমানিয়া’ বলে সবাই। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আজিজুল হক সাহেবের ছেলে মাহফুজুল হক। প্রথম ধারাটি এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহানুভূতিপ্রত্যাশী; দ্বিতীয় ধারাটির একাংশ জাতীয় পার্টি এবং আরেকাংশ বিএনপির দেওয়া একটি আসনে লড়বে।

এর বাইরে দেওবন্দী ঘরানার পৃথক দুটি ধারা রয়েছে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী ও মুফতি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে। জমিয়তের কাসেমী সাহেবের কেন্দ্র বারিধারার জামিয়া মাদানিয়া। মূলত, দেওবন্দ-মাদানি ঘরানার আজকের প্রজন্ম এই অংশ বিএনপি জোটে শরিক।

জামায়াত-কওমি: আকিদাগত টানাপোড়েন
নির্বাচনী রাজনীতির নানা জোটে ইসলামি দলগুলোর ছোটাছুটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, ‘ক্ষমতা’র ভাগ খুঁজছে তারাও। এটা একই সঙ্গে তাদের একত্র হয়ে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এক রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠারও প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতার পেছনে অন্যতম কারণ অভিভাবকসুলভ ব্যক্তিত্বের ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্পষ্টতা।

এ মুহূর্তে কওমি ঘরানার ‘বড় হুজুর’ হাটহাজারীর মাওলানা আহমদ শফী। ‘হেফাজত’ই সব কওমির জাতীয় জোট হলেও প্রায় ৯৮ বছর বয়সী আহমদ শফী রাজনীতিতে অনাগ্রহী বলেই বার্তা দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। পাশাপাশি কওমি পরিমণ্ডলে দফায় দফায় অনেক বিতর্কও উঠেছে তাঁকে নিয়ে। একই পরিবারের অপর ‘মুরব্বি’ জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে আহমদ শফীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি করতে পারাও ইসলামি শক্তির প্রতিপক্ষের অন্যতম সফলতা।

কওমিভিত্তিক দলগুলোর সবলতার জায়গা যেমন মাদ্রাসা ও এর জনশক্তি, দুর্বলতার দিকও সেটাই। প্রতিটি মাদ্রাসা এক স্বশাসিত জগৎ; চলে মূলত প্রিন্সিপালের কর্তৃত্বে। অনেক প্রিন্সিপাল একত্র হলে কওমিরা একটা শক্তি। কিন্তু তাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস থাকা মানেই নিষ্ক্রিয়তা। ঐক্য ও বিরোধের এই দৃশ্য হামেশা দেখা যায়।

এভাবেই বিপুল ভোটব্যাংক থাকার পরও ইসলামি দলগুলো নেতৃত্বহীন ও বহুধাবিভক্ত থাকছে। সঙ্গে রয়েছে জামায়াত-কওমি টানাপোড়েন। পল্টন থেকে হাটহাজারীর মতোই বেশ দীর্ঘ এই বিবাদ ও ব্যবধান। বহু বছর একই জোটে থেকেও কওমিরা বরাবরই জামায়াতকে ‘ভ্রান্ত আকিদা’ ভাবে। আকিদাসংক্রান্ত এসব কাজিয়া দুই পক্ষকে একক রাজনৈতিক সত্তা হতে দেয় না। আবার এরূপ বিবিধ কারণেই দেশের প্রধান দুই জোট ইসলামি দলগুলোকে ‘সামান্যে তুষ্ট’ করার চেষ্টায় থাকে এবং তা পারেও। এবারের আসন বরাদ্দকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনী অর্জন সীমিতই থাকছে। এককভাবে জামায়াত হয়তো ২০ থেকে ২৫টি আসনে লড়বে। আরও কয়েক দিন পরই প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। তবে ইসলামি দলগুলোর যারাই যে আসনে জিতুক, সেটা হবে নৌকা বা ধানের শীষ পরিচয়ে; কোনোভাবেই ইসলামি পরিচয়ের সংগঠিত শক্তির প্রকাশ হিসেবে নয়।

সংগঠকদের ব্যর্থতা: কিন্তু তরুণেরা আসছে
পরনির্ভরতার এই রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে বিপুল কর্মীবাহিনী থাকার পরও ইসলামি, দেওবন্দী, বেরলভী—কোনো ঘরানার দলই বিগত দশকগুলোয় তাদের সামাজিক ভাবমূর্তি বাড়াতে পারেনি। সমাজে যে শোষণ-বঞ্চনা-লুটপাটতন্ত্র চলছে, তার বিরুদ্ধে ইসলামি দলগুলো সামান্যই দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও দেওবন্দ ধারার শক্তিগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। জামায়াত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কিন্তু একের পর এক নেতৃত্বের ফাঁসি জামায়াতের ভেতরে সাংগঠনিক ও আদর্শিক সংস্কারের তাগিদকে কোণঠাসা করে রক্ষণশীল ধারাকেই আবারও শক্তিশালী করে তুলেছে। ফল হয়েছে এই, জামায়াতের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরিসরে চলছে পুরোনো স্থবিরতা।

এ রকম পটভূমির ব্যতিক্রমী দিক হলো উপরিউক্ত প্রতিটি দলেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তরুণেরা রয়েছে। নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের পর বামপন্থী ধারার দলগুলোর উল্টো চিত্র দেখা গেছে ইসলামি ধারার দলগুলোয়। এসব দলে গত দুই-তিন দশকে তরুণ-তরুণীদের সদস্যপদের হার বেড়েছে। কিন্তু সেই তরুণদের কার্যকর কোনো একক রাজনৈতিক সম্ভাবনা আকারে দানা বাঁধাতে পারেনি সংগঠকেরা। নেতৃত্ব তরুণদের দিয়ে ‘জাহেলিয়াত’ মোকাবিলায় যতটা সচেষ্ট ছিল, বেইনসাফির বিরুদ্ধে ততটা সরব নয়।

সরেজমিন চিত্র বলছে, এ ক্ষেত্রে আপাতত কোনো ‘সম্ভাবনা’ও হাজির নেই। নেই জামায়াতের সঙ্গে কওমিদের রাজনৈতিক মৈত্রীরও কোনো অবকাশ, যা আওয়ামী লিগ-বিএনপির জন্য ভবিষ্যৎ স্বস্তির বিষয় বটে!

আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক