'ঈশ্বর, রোহিঙ্গাদের রক্ষা করুন'

রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ শেষ হওয়ার নয়
রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ শেষ হওয়ার নয়

পৃথিবীর অনেক এলাকায় চলছে যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘাত, জ্বলছে আগুন, ফাটছে বোমা, ঝরছে রক্ত, মরছে মানুষ পোকামাকড়ের মতো। জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ছুটছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। সে তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া শান্তিপূর্ণ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। কখনো যদি কোনো বিষয়ে সমস্যা দেখা দেয়, তা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা করে। বাংলাদেশ সংঘাতে যায় না।

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমার। কিছুকাল আগেও এর নাম ছিল বার্মা। শৈশবে আমরা একে জানতাম ‘ব্রহ্মদেশ’ নামে। প্রায় ৯০ শতাংশ বর্মন জাতিসত্তার মানুষের বাসভূমি বলে এর নাম ছিল ব্রহ্মদেশ বা বার্মা। ঔপনিবেশিক আমলের পর থেকেই দেশটি সেনাশাসিত বা সেনানিয়ন্ত্রিত। দেশটির অধিপতি শ্রেণির মধ্যে সেনাপতি ও বৌদ্ধ ধর্মগুরুদেরই প্রাধান্য। বেসামরিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি মিয়ানমারে গড়ে ওঠেনি। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কী জিনিস, তা তারা জানে না। সেই অবস্থায় ইউরোপে শিক্ষাপ্রাপ্ত অং সান সু চি যখন গণতন্ত্রের কথা বললেন, পশ্চিমীরা তাঁকে উৎসাহিত করল। প্রতিবেশী হিসেবে আমরাও ভেবেছিলাম সু চির নেতৃত্বে সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হবে এবং সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু সে গুড়ে যে বালি, তা শিগগিরই বোঝা গেল। গণতন্ত্রের যে জামা তিনি পরে থাকেন, ওটা তাঁর ছদ্মবেশ।

গত কয়েক দশকে মিয়ানমারে সহিংস বৌদ্ধ মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। উগ্র মৌলবাদী চার লাখ বৌদ্ধভিক্ষুর সেই আন্দোলনের ২০০৭ সাল থেকে নামকরণ হয় ‘স্যাফ্রোন রেভল্যুশন’ বা ‘গেরুয়া বিপ্লব’। ধর্মনেতারা আন্দোলনটা কোনো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে শুরু করেননি, কিন্তু অবিলম্বেই দেখা গেল উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাই তাঁদের লক্ষ্য।

বার্মার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হাজার বছরেরও বেশি সময় যাবৎ। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে মধ্যযুগে। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী প্রমুখ আরাকান রাজসভারই কবি। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থানের পর থেকে সেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্য ধর্ম, বর্ণ, ভাষাভাষীর নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ করা হয়।

সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ মৌলবাদীদের বর্বরোচিত উৎপীড়ন থেকে জান বাঁচাতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা দীর্ঘ দিন থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত এলাকায় অব্যাহতভাবে অত্যাচার ও গণহত্যা চালাচ্ছে। পৃথিবীতে মানবাধিকার বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তার লেশমাত্র নেই রোহিঙ্গাদের জীবনে। রোহিঙ্গাদের অবস্থা খাঁচায় ঢোকানো বন্দী প্রাণীর মতো। শুধু সেনাবাহিনী নয়, তারা উগ্র বৌদ্ধ মৌলবাদীদেরও নির্যাতনের শিকার পশ্চিমী গণমাধ্যমের খবরেই জানা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে চাল, ডাল, আটা শুধু নয়, পানি পর্যন্ত নিতে দিচ্ছে না তারা।

গত বছর সেপ্টেম্বরে যখন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন মিয়ানমারে আসে, তাদের অপদস্ত করা হয়। তাৎপর্যের বিষয়, গত বৃহস্পতিবার যখন কফি আনান কমিশন তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, সেই দিনই রোহিঙ্গাদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। কফি আনানের প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং তাদের চলাচলে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার।

সারা বছরই কমবেশি নির্যাতন-নিপীড়ন চলে, কিন্তু ২০১২-তে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে বীভৎস সংঘাত হয়। ২০১৩-তে মুসলিমবিরোধী সংঘর্ষ রাখাইন রাজ্যের বাইরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪-তে মুসলিমবিরোধী একতরফা দাঙ্গায় মান্দালয়ে বহু হতাহত হয়। গতবার থেকে অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নারী নির্যাতন প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে রাখাইন প্রদেশে। রোহিঙ্গাদের অপরাধ দুটো: তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাংলায় কথা বলে এবং তারা ধর্মে মুসলমান।

স্যাফ্রোন রেভল্যুশনের রেশ কাটতে না-কাটতেই পশ্চিমীরা সেখানে দেখতে পায় ‘বার্মিজ ডেমোক্রেটিক স্প্রিং’—বর্মী গণতন্ত্রের বসন্ত। পশ্চিমীরা যেখনই গণতন্ত্রের আভাস পায়, সেখানেই দেখতে পায় বসন্তের স্নিগ্ধ সুবাতাস। কয়েক বছর আগে আরবের ওপর মরুভূমির মধ্যে তারা আবিষ্কার করে বসন্তের। বর্মী গণতান্ত্রিক বসন্তের স্বাদ সেখানকার মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টানরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

পশ্চিমী প্রচারমাধ্যম কখনো, বলতে গেলে অধিকাংশ সময় তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সাধারণকে অসাধারণ করে চিত্রিত করে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশের কোনো কোনো সাধারণ নেতার অসাধারণ ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। আর যদি তার কথাবার্তায় গণতন্ত্রের গন্ধ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। তাকে দেবী বা দেবতা বানিয়ে ছাড়ে। এ ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত কর্মী নেত্রী অং সান সু চি।

সু চির রাজনীতি ধর্মভিত্তিক। তাঁর নিজের ধর্ম বৌদ্ধধর্মনির্ভর, যাকে বলা যায় বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ। তিনি তাঁর এক রচনায় ফতোয়া দিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতাদের বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র বর্ণিত ন্যায়পরায়ণ রাজার ‘দশ-রাজধম্ম’ নীতি অনুসরণ করা কর্তব্য। একজন শাসকের কী সেই রাজ-ধম্ম? সেগুলো হলো: ঔদার্য, নীতিজ্ঞান, আত্মত্যাগ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, দয়া, কৃচ্ছ্র, ক্রোধহীনতা বা অহিংসা, সহিষ্ণুতা এবং আত্মসংযম। [‘ইন কোয়েস্ট ফর ডেমোক্রেসি’, ১৯৯১] তাঁর এই উচ্চ নৈতিকতামূলক রচনা পাঠ করে পশ্চিমী নীতিনির্ধারকেরা দেখলেন, তিনি যে শুধু ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ তা-ই নন, পশ্চিমের গণতন্ত্রের যে ধারণা তার অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। অ্যারিস্টটল, রুশো, ভলতেয়ার তাঁর কাছে কিছু নন। এই রকম উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন একজন মহাজ্ঞানী ও মহাগণতন্ত্রী যদি নোবেল পুরস্কার না পান, তবে ব্যাপারটি কেমন দেখায়! নোবেল পুরস্কার তাঁকে দেওয়া উচিত ছিল সাহিত্যে, কিন্তু তাঁরা দেখলেন নিজ দেশে এবং এশিয়ায় মানবতার বাণী প্রচারক হিসেবে তিনি মহাত্মা গান্ধীকে ছাড়িয়ে গেছেন। সুতরাং, তাঁর প্রাপ্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। নিজের দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা হবে অতুলনীয়। ‘দশ-রাজধম্ম’ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে তাঁর দেশে। ব্রহ্মদেশের খ্রিষ্টান, হিন্দু ও মুসলমানরা এখন তাঁর ‘রাজধম্মে’র স্বাদ গভীরভাবে পাচ্ছে।

সু চির মধ্যে পশ্চিমী প্রচারমাধ্যম ও তাঁর ভক্তরা আবিষ্কার করেন এক বিশুদ্ধ শাসকের প্রতিমূর্তি, তাঁদের ভাষায় ‘বোধিসত্ত্ব’। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: ‘আপনি কি একজন নারী বোধিসত্ত্ব?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন বিগলিত হয়ে: ‘ওহ ফর গুডনেস সেক, আই অ্যাম নোহয়ার নেয়ার দ্যাট স্টেজ।’ তিনি বলতে চেয়েছেন, ওই পর্যায়ে না পৌঁছালেও তাঁর কথা থেকে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিছুটা তো তিনি পৌঁছেছেন বটে। কারণ, সম্ভাব্য ‘বোধিসত্ত্বে’ তিনি পৌঁছাননি, তা অস্বীকারও করছেন না। [অং সান সু চি, দ্য ভয়েজ অব হোপ—কনভারসেশনস উইথ এলান ক্লিমেন্ট, লন্ডন, ১৯৯১, পৃ. ৯]

অত্যাচারিত ও বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের সু চি আখ্যায়িত করেছেন ‘বাঙালি দুষ্কৃতকারী’ বলে। তিনি সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিপীড়ন বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও শান্তিবাদী সু চির অন্তঃকরণে করুণার উদ্রেক করেনি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদীর তীরে যে হাজার হাজার অসহায় মানুষ—শিশু, নারী, বৃদ্ধ—হাহাকার করছে, তা তাঁর কাছে না পৌঁছালেও বিশ্ব খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস রোববার সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে এক প্রার্থনাসভায় বলেছেন, ‘ঈশ্বর, রোহিঙ্গাদের রক্ষা করুন।’ মহামান্য পোপ বলেছেন, এই নিপীড়ন বেদনাদায়ক। তিনি সংখ্যালঘু ‘রোহিঙ্গা ভাইদের’ পূর্ণ অধিকার প্রদানের জন্য সবাইকে প্রার্থনা করতে বলেন।

বার্মিজ সমাজে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সব সময়ই ছিল, সেটা ভয়ের ব্যাপার নয়। কারণ, মহান বৌদ্ধধর্মের নৈতিকতাকে সব ধর্মের মানুষই সম্মান করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ অ-বৌদ্ধদের উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছে। রাজধানীর বিলবোর্ডগুলোতে যখন লেখা থাকে, মিয়ানমারের সংবিধানে বৌদ্ধধর্মের ‘স্পেশাল পজিশন’—‘এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম—বৌদ্ধধর্ম’, তখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও বর্মন জাতিসত্তার মানুষের বাইরে অন্যদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটে বৈকি!

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও তাদের নাগরিক অধিকার হরণ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তা বাংলাদেশকে বিপন্ন করছে। জনবহুল বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ সহ্য করছে। বাংলাদেশে বহু উগ্র ইসলামি গোষ্ঠী সক্রিয়। অভাবের তাড়নায় রোহিঙ্গাদের অনেকে ওইসব গোষ্ঠীতে যদি যোগ দেয়, তা হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।সুতরাং, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। সহায়তা নিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবিলম্বে এ উদ্যোগ নিতে হবে জাতীয় স্বার্থে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।