'উজানে আব্বাসউদ্দীন'

মুস্তাফা জামান আব্বাসী
মুস্তাফা জামান আব্বাসী

জানতাম না অপেক্ষা করছে কয়েকটি সুন্দর দিন। অতি পরিণত বয়সে কলকাতায় আমার একটি অনুষ্ঠান। আগে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন, কয়েকটি কমার্শিয়াল অনুষ্ঠান ও আব্বাসউদ্দীন স্মরণ সমিতির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি বৈকি। আব্বাসউদ্দীন স্মরণ সমিতি ৪০ বছর ধরে ড. সুখবিলাস বর্মার  প্রচেষ্টায় আব্বাসউদ্দীনকে স্মরণ করেছে নানা অনুষ্ঠানে।

কখনো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, ভগ্নি, ভ্রাতুষ্পুত্রী গিয়েছেন। আমিও  দু-একবার গিয়েছি। সেখানে হাজার তারার ভিড়ে আমি একজন আগন্তুক শিল্পীমাত্র। কিন্তু এবার আমি স্বমহিমায় একক শিল্পী সারা দিন ও পরের দিন দুই ঘণ্টার জন্য কলকাতায় শত শত অনুরাগীর মাঝখানে যখন আব্বার গানগুলো ৫০ বছর পরে দোতারার ডোল ডংয়ের সঙ্গে নতুনভাবে মূর্ছনা পেল, তখন শিহরিত আমি। আব্বাসউদ্দীন স্মরণ সমিতি এবার ‘উজানে আব্বাসউদ্দীন’ নামে দুই দিনের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। 

এই কলকাতাই শিল্পী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল আমার পিতাকে। মেসে ছিলেন, পকেটে নেই দুটিও উদ্বৃত্ত পয়সা, তবু শহরের বড় বড় অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়তই। এ গান তারা পাবে কোথায়? একই দিনে দু-তিনটি অনুষ্ঠানের আহ্বান। সামান্য পয়সার বিনিময়ে গাইছেন কোচবিহার বলরামপুর গ্রামের নিভৃত পল্লির প্রাণ নির্যাস, ‘ও কী একবার আসিয়া সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়া’, ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’সহ আরও কত গান।

পরিবেশন করেছিলেন বিদগ্ধ সুধী সমাজের সামনে প্রথম ভাটিয়ালি, রাখালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মারফতি, মুর্শিদি, সামনাসামনি ও গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। শুধু একটি হারমোনিয়াম ও দোতারা। ক্যাসেট নেই, সিডি নেই, টিভি নেই। শিল্পসম্মত দরদি কণ্ঠ, দরাজ পরিবেশনায় মুগ্ধ কলকাতা। প্রজন্মের নতুন শিল্পীরা তাঁকে ভুলতে পারেননি। দূর থেকে ভেসে আসা আকুল কণ্ঠের আবেদন হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

 ‘উজানে আব্বাসউদ্দীন’ দুই দিনের ওয়ার্কশপ। বেছে সুন্দর গানগুলো গেয়ে শোনালাম। ভাটিয়ালি কেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বোঝালাম। শ্রেষ্ঠ: বিচ্ছেদি। মানব-মানবীর ভালোবাসার উপাদান, সে তো বিচ্ছেদি, আর কিছু নয়। যে গান শুনলে পাষাণ হৃদয়েও অশ্রু প্রবাহ হয়। আমরা যে সবাই ভালোবাসতে শিখেছি, তাই ভালোবাসার গান আমাদের শ্রবণে আনে বিরহের সুর। লিখছেন শত শত মুসলমান কবি, রাধা বা কৃষ্ণপূজ্য দেবতা নয়, বরং ভালোবাসার পরম উপলব্ধি, যে ভালোবাসায় বাস করে অনন্ত বিরহ, মিলন, আবার বিরহ, চিরবিরহ। বাংলাদেশ বিচ্ছেদি গানের মূল অববাহিকা। গাইছি আর কাঁদছি, পিতার জন্য, ফেলে আসা কালজানি, তোরসা নদীর জন্য, যাকে ভালোবাসি তার জন্য। চিরদিনের জন্য ভাগ হয়ে গেছি, গানগুলো নয়। রবীন্দ্রনাথ ভাগ হননি, নজরুলও নন। তেমনি আব্বাসউদ্দীন।

লোকসংস্কৃতির পূর্ণ নির্যাসে অবগাহিত কয়েকটি সংগঠন: মনদরিয়া, কলকাতা শ্রুতিজাতক, নব নান্দনিক, কলাপী, শিকড়, উদ্যোক্তা। আহ্বায়ক দুজন—অভিজিৎ চক্রবর্তী ও সুখেন্দু দাস। কলকাতার সংগীতপাগল অনেক মানুষ কার্ড পেয়েছেন। তবে তা আমাদের মতন বিনিপয়সার কার্ড নয়, ভালো পয়সার বিনিময়ে। সব কার্ড শেষ। অনেক লোক প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন চারটা পর্যন্ত। দৈবাৎ যদি একটি কার্ড পাওয়া যায়। আমার সঙ্গে যাঁরা সংগত করেছেন কলকাতার শ্রেষ্ঠ তাঁরা, যেমন: মৃগনাভি [বিখ্যাত ঢোলবাদক, যাঁকে এবার পুরস্কৃত করা হলো]।

আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট পুরুষ অভিজিৎ বসু। বক্তৃতা—শুভেন্দু মাইতি, যিনি লোকসংগীতের বটবৃক্ষ। যাঁকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর নাম বলতেই হবে। অন্যতম শ্রেষ্ঠ দোতারা বাদক মোহাম্মদ সোলাইমান, যাঁর দোতারার ডাং জীবনেও বিস্মৃত হবে কি না সন্দেহ।

তাঁরা ভালোবাসেন ভাওয়াইয়া। খুঁজে বেড়ান ভালো গানের অনুষ্ঠান, কলকাতার যেকোনো প্রান্তেই হোক, এখানেও। সুন্দর করে সাজিয়েছেন মঞ্চ। আব্বাসউদ্দীনের ছবি আঁকা দুই দিক থেকে। জানালাম, আজকের অনুষ্ঠানে এসেই বুঝতে পেরেছি আব্বাসউদ্দীনের আত্মা উপস্থিত।

যমুনার তীরে যা দেখেছি তা স্বাভাবিক নয়। এক শ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ পদ্মার তীরে বোটের মধ্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস যখন ভেসে বেড়াতেন, তখন যে ভাটিয়ালির কথা শুনেছেন নিজ কানে, কোথায় সেই ভাটিয়ালি, যে ভাটিয়ালির কথা আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর দীর্ঘ বিবরণে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাব্যাপী লিখে গেছেন, কোথায় সেই ভাটিয়ালি? শচীনদেব বর্মন যে গানগুলো গেয়ে গেছেন, যেখানে ছিল তাঁর ফেলে আসা যৌবনের ভাটিয়ালি, কেমন করে সেই সুরগুলো নিল চিরবিদায়? আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ফরিদপুর অঞ্চলের সংগৃহীত গানগুলো বাংলার মানুষের অন্তর অধিকার করে ছিল দীর্ঘকাল। কানাইলাল শীলের কাছে শেখা ও আমাদের সংগৃহীত যে শত গান সুরের মালঞ্চে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা সেদিন, কোথায় সেই ভাটিয়ালির বাংলাদেশ?

গান শুনতে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা অশ্রুসজল। এ কোন দেশের গান? কেন ওদের নিজের দেশের, যার নাম বাংলা! ‘উজানে আব্বাসউদ্দীন’-এর যাঁরা আহ্বায়ক, দুজনই পুত্রসম। চোখে তাঁদের গঙ্গা ও পদ্মার অশ্রুজলের প্লাবন। গানে গানে তিনটি দিন কেমন করে ফুরিয়ে গেল। যে পাঁচ প্রতিষ্ঠান এক ঘণ্টা ধরে তাদের নিজেদের গান শোনাল, তা ভুলতে পারব না। কারণ, পরিবেশনার অভিনবত্ব। যেখানে কদিন ছিলাম সেই প্রতিষ্ঠানের নাম, ‘ডান্সার্স গিল্ড’। মঞ্জুশ্রী চাকি সরকারের রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘নবনৃত্য’।

এত সুন্দর নৃত্যের প্রতিষ্ঠান আগে দেখার সুযোগ পাইনি। ‘তোমারই মাটির কন্যা’, ‘অরণ্য অমৃত’, ‘যুগসন্ধি’, ‘পরমা প্রকৃতি’, ‘কোন নতুনের ডাক’, ‘আনন্দ বসন্ত সমাগমে’, ‘এই আকাশের মনের কথা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ কোনো দিন দেখিনি। নৃত্যের জন্য কেমন করে প্রস্তুত করতে হয় দেহবল্লরী, কোন সূত্রে নৃত্য ও গীত পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ, বুঝতে সক্ষম হলাম মুহূর্তেই। আর আমি দু-চারটি গান গাইতেই ছাত্রছাত্রীরা হয়ে পড়ল অশ্রুসিক্ত। বলল, এই দেখা শেষ দেখা নয়। আবারও দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।