সকাল ৮টা ৩৫ মিনিট। শাহবাগে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির গেটে পুলিশ। ভেতরে দুটি ভোটকেন্দ্র। পুলিশ ভোটার ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি নির্বাচন কমিশনের দেওয়া অনুমতিপত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে তিনটি লাইন। দুটিতে পুরুষ, একটিতে নারী ভোটাররা দাঁড়িয়ে আছেন। গুনে দেখলাম পুরুষ ৩৯ জন, নারী ১১ জন। নারী ভোটারদের লাইনের পাশে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনারা কি ভোট দিতে আসার পথে কোনো বাধাবিপত্তি বা ভয়ভীতির সম্মুখীন হয়েছেন?’
‘না, কোনো বাধা পাই নাই।’ বললেন এক মধ্যবয়সী নারী, তাঁর পাশের কজনও না-সূচক মাথা ঝাঁকালেন।
৩৮৬ নম্বর ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকলাম। নারী ও পুরুষদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বুথে ভোট গ্রহণ চলছে। শান্ত পরিবেশ, কোনো শোরগোল নেই। উভয় বুথে বিভিন্ন প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টরা বসে আছেন। তাঁদের গলায় ঝুলছে নিজ নিজ প্রার্থীর মার্কাসহ ছবি। বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাস ও তাঁর মগ মার্কার ছবি কারও গলায় ঝুলতে দেখলাম না। এজেন্টদের জিগ্যেস করলাম, এখানে কি মগ মার্কার কোনো এজেন্ট আছেন? এক মধ্যবয়সী নারী বললেন, ‘আছি, আমি আছি।’ আমি তাঁকে জিগ্যেস করলাম, ‘ভোট গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে?’ তিনি মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘হচ্ছে, আপাতত হচ্ছে।’
প্রায় ১০ মিনিট ভেতরে দাঁড়িয়ে ভোট গ্রহণ দেখলাম। বেরিয়ে এসে দেখতে পেলাম, ভোটারদের লাইনগুলো লম্বা হয়েছে, আরও ভোটার এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। সকাল সোয়া নয়টায় গুনে দেখলাম পুরুষদের লাইনে ৮১ জন, নারীদের লাইনে ২০ জন।
সকাল ১০:১০ মিনিট। উদয়ন স্কুল ভোটকেন্দ্রের বাইরে রাস্তায় প্রচুর তরুণ-তরুণী। সবার বুকে-গলায় সাঈদ খোকনের ইলিশ মাছ মার্কার ব্যাজ। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো ভিড় নেই। দোতলায় ভোট গ্রহণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে সাতটি বুথ, অধিকাংশ বুথেই ভোটার নেই। ২০৭ নম্বর কক্ষের বুথে ঢুকে দেখতে পেলাম হাত গুটিয়ে বসে আছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা; পোলিং এজেন্ট মাত্র তিনজন। সেখানে মির্জা আব্বাসের কেউ নেই। তাঁর পোলিং এজেন্ট নেই ২০৮ নম্বর কক্ষের বুথেও। ২০৯ নম্বর কক্ষে ঢুকে মগ মার্কার পোলিং এজেন্টের খোঁজ করলে এজেন্টদের মধ্যে থেকে এক পুরুষ তাঁর পাশে বসা এক নারীকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি মগ মার্কার এজেন্ট।’ আমি ওই নারীকে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনি মগ মার্কার এজেন্ট?’ তিনি মৃদুভাবে মাথা দোলালেন, মুখে কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। ২১৩ নম্বর কক্ষেও একজন নারীকে দেখিয়ে এক পুরুষ এজেন্ট আমাকে বললেন যে ওই নারী মগ মার্কার এজেন্ট।
একটি বুথের সামনে দাঁড়ানো পুলিশের এক সদস্যকে জিগ্যেস করলাম, ‘ভোটার উপস্থিতি কি সকাল থেকেই কম?’ তিনি বললেন, ‘এই রকমই, টুকটাক একজন-দুজন করে আসতেছে, ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছে।’
প্রায় ৪০ মিনিট কাটালাম এই কেন্দ্রে। ভোটারদের উপস্থিতি বাড়তে দেখা গেল না।
বেলা ১১টায় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে পৌঁছে দেখা গেল গেটের বাইরে প্রচুর ভিড়। মনে হলো, এখানে ভোট জমেছে। ভেতরে তিনটি তলায় তিনটি ভোটকেন্দ্র। নিচতলায় ৩৮২ নম্বর ভোটকেন্দ্র শুধু নারীদের জন্য, মোট ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ২১৪। নারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছেন, তিনজন নারীকে জিগ্যেস করলাম, পরিবেশ কেমন, তাঁরা কোনো সমস্যা বোধ করছেন কি না। প্রত্যেকেই বললেন, পরিবেশ শান্তিপূর্ণ, কোনো সমস্যা নেই। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জিগ্যেস করে জানা গেল, একটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ১৫ শতাংশ। দোতলায় ৩৮১ নম্বর ভোটকেন্দ্রের সাতটি বুথের মধ্যে শুধু ৪ নম্বর বুথের সামনে লম্বা লাইন। যে ভোটার দরজার মুখে পৌঁছে গেছেন, তাঁকে জিগ্যেস করলাম, তিনি কতক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, প্রায় এক ঘণ্টা। এই বুথের ভেতরে ঢুকে প্রথমেই মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী এজেন্টকে খুঁজলাম। অন্য এক এজেন্ট বললেন, তিনি বাথরুমে গেছেন। ২ নম্বর বুথে এক যুবক বললেন, তিনি মগ মার্কার এজেন্ট। আমি তাঁকে জিগ্যেস করলাম, এখানে তিনি কোনো সমস্যা বোধ করছেন কি না। তিনি বললেন, ‘না, কোনো সমস্যা নাই।’ ৩ নম্বর বুথে একজন বললেন, এখানে মগ মার্কার কোনো পোলিং এজেন্ট আসেননি। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জিগ্যেস করে জানা গেল, বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রায় ১২ শতাংশ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
তিনতলায় ৩৮৩ নম্বর ভোটকেন্দ্র ফাঁকা। এক পুলিশ সদস্য জানালেন, এই কেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য। আমি জানতে চাইলাম, তাঁরা কি ভোট দিতে আগ্রহী নন? তিনি হেসে বললেন, কে জানে? প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানালেন, ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ৮ শতাংশ।
ভোটকেন্দ্রের বাইরে এসে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালাম। এক ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন?’ আমি আমার পেশাগত পরিচয় দিলাম। তিনি বললেন, ‘আপনি যখন ২ নম্বর বুথে ঢুকেছিলেন, তখন আমি সেখানে ভোট দিচ্ছিলাম। যে ছেলেটা আপনাকে বলল যে সে মগ মার্কার এজেন্ট, তাকে আমি চিনি। সে ছাত্রলীগের একজন ক্যাডার।’ আমি তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে, তিনি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি আরও বললেন, ‘কোনো ভোটকেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর কোনো পোলিং এজেন্ট নাই। কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। কার্জন হলে গিয়ে দেখেন, বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না।’
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটলাম কার্জন হলের ভোটকেন্দ্রে। বিশাল হলঘরের দরজায় নারী ও পুরুষ ভোটারের লম্বা লাইন, ভেতরে একাধিক বুথে ভোট গ্রহণ চলছে। শান্তি–শৃঙ্খলার কোনো ব্যত্যয় চোখে পড়ল না। এখানেও মির্জা আব্বাসের পোলিং এজেন্টের খোঁজ করলাম; একটি বুথে এক যুবক বললেন, ‘আমি মগ মার্কার এজেন্ট।’ কিন্তু তাঁর বুকে ঠেলাগাড়ি মার্কার ব্যাজ দেখে জিগ্যেস করলাম, এই ব্যাজ কেন? তিনি বললেন, ‘লাগাইতে হইছে।’ অন্য বুথগুলোতে জিগ্যেস করলে অন্য এজেন্টরা বললেন, এখানে মগ মার্কার একজন এজেন্টও আসেননি।
বেলা সোয়া ১২টায় বকশীবাজারে বদরুন্নেসা কলেজ ভোটকেন্দ্রের বাইরে রাস্তায় বিরাট জটলা। গেটের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছেন অনেক তরুণ-যুবক। তাঁরা উত্তেজিত, হইচই করছেন। পুলিশের সদস্যরা তাঁদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জানা গেল, জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। গেটের বিপরীত দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তিন-চারটি মোটরযানে করে র্যা বের সদস্যরা এসে মুহূর্তের মধ্যে রাস্তা ফাঁকা করে ফেললেন। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ চলছে, কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই।
বেলা সোয়া একটা। লালবাগের আমলিগোলা জগন্নাথ সাহা রোডে জগৎমোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। নারী ও পুরুষদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দুটি ভোটকেন্দ্রে নিরিবিলি, ঝঞ্ছাটহীন ভোট গ্রহণ চলছে। লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের জিগ্যেস করলে তাঁরা বললেন, ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।’ এই সময় কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘মগ মার্কার লোকেরা সব চইল্যা যাইতাছে।’ তড়িঘড়ি ভোটকেন্দ্র থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখতে পেলাম, এক মধ্যবয়সী পুরুষ তিন যুবককে সঙ্গে নিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আমি তাঁকে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনারা কি মগ মার্কার এজেন্ট?’ তিনি বললেন, ‘হ’।
ভোট শেষ না হতেই চলে যাচ্ছেন কেন? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি চোস্ত ঢাকাইয়া উচ্চারণে বললেন, ‘উপ্রের নির্দেস, চইল্যা আহো!’
একটু পরেই অফিস থেকে সহকর্মীর ফোন: ‘মশিউল, অফিসে চলে আসেন। বিএনপি ইলেকশান বয়কট করেছে।’
ভাবলাম, নির্বাচনী দৃশ্যপটে অনুপস্থিত যে পক্ষটিকে সকাল থেকে খুঁজছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না, সে পক্ষ যখন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল, তখন এই নির্বাচনের পরিণতিও কি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতোই হবে না?
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷