'এই হরতাল, সেই হরতাল নয়'

বৃহস্পতিবার দুপুরে হরতাল চলাকালে পল্টন মোড়ের দৃশ্য
বৃহস্পতিবার দুপুরে হরতাল চলাকালে পল্টন মোড়ের দৃশ্য

প্রখর রোদে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ঘামছেন: বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মগবাজার মোড়ে বিতিকিচ্ছি যানজট। বাংলামোটর থেকে মৌচাক-মালিবাগের দিকে গেছে যে সড়ক, তা ভরে আছে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস, মিনিবাস, টেম্পো, হিউম্যান হলার ইত্যাদি যানবাহনে। মাঝেমধ্যে কিছু প্রাইভেট কারেরও দেখা মিলছে। সড়কের দুই পাশের অধিকাংশ দোকানপাট খোলা। লোকজনের চোখেমুখে শঙ্কা-উদ্বেগের ছায়া নেই, ঢাকা মহানগরের কর্মব্যস্ত জনজীবন চলছে নিজস্ব স্বাভাবিক ছন্দে।
অথচ এটা হরতালের দিন। জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের দিনগুলোতে ঢাকার মগবাজার এলাকার সাধারণ মানুষ বিশেষ রকমের উদ্বেগের মধ্যে থাকে। কারণ দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এই এলাকায় অবস্থিত, দলটির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর কার্যালয় এবং এর নেতা সদ্যপ্রয়াত গোলাম আযমের বাড়িও মগবাজারেই। জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা তাঁদের ডাকা হরতালের দিনগুলোতে মগবাজার, মতিঝিল, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, বিজয়নগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে হরতাল ‘সফল’ করার জন্য বিশেষভাবে তৎপর থাকেন। হরতাল ‘সফল’ করতে তাঁদের সুসংগঠিত তৎপরতা সাধারণত সহিংস হয় বলেই জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দিনগুলোতে মানুষ শঙ্কিত না হয়ে পারে না।
কিন্তু আজ কারও চোখে-মুখে শঙ্কা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তা নেই। মগবাজার মোড়ের যানজট হেঁটে পার হয়ে এক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়ে যাবেন কি না। তিনি জানালেন, অফিসটির অবস্থান তাঁর জানা নেই। আমি তাঁকে পথ দেখিয়ে দিতে পারি বললে তিনি কুড়ি টাকায় রাজি হলেন। পথে যেতে যেতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ হরতাল এ কথা তিনি জানেন কি না।
‘জানুম না আবার?’ হেসে বললেন তিনি, ‘সারা সপ্তাহ ধরেই তো হরতাল চলতাছে। কিন্তু এই হরতাল সেই হরতাল না।’
আমি জানতে চাইলাম ‘সেই হরতাল’ বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন।
‘মানে, কইলাম, এই হরতালের ত্যাজ নাই। মিছিল নাই, জ্বালাও-পোড়াও নাই, সবই চলতাছে, কিছুই তো বন্ধ নাই।’ যুবক রিকশাচালকটিকে বেশ আলাপী মনে হলো। যেতে যেতে তিনি অনর্গল কথা বলে চললেন: ‘দেখছেন না, কেমুন জাম লাইগ্যা রইছে? হরতাল হলে কি জাম লাগে? মানুষ ভয়ে গাড়ি বার করত না, যদি আগুন লাগায়া দেয়। একবার তো আমার চক্ষের সামনে একখান বাসে আগুন দিল; আমি লগে লগে গাড়ি নিয়া বাসায় গেছি গা।’
রাশমনো হাসপাতাল পার হয়ে বাঁ দিকে ঘুরে রেলক্রসিং পেরিয়ে রিকশা এগোতে থাকে। এই রাস্তায়ও বেশ ভিড়, প্রায় সব দোকানপাট খোলা। রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার ও পায়ে হেঁটে মানুষ চলাচল করছে অন্যান্য দিনের মতো। জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম যেখানে ছাপা হয়, সেই আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের সামনে পৌঁছে রিকশাচালককে থামতে বলি। বিশাল লোহার গেটটি বন্ধ। একটু দূরে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের একটি কাভার্ড ভ্যান, সেটিতে বসে, আর নিচে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশের কয়েকজন সশস্ত্র সদস্য। তাঁদের হাতে ঢাল নেই, মাথায় হেলমেট নেই, বুকে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট নেই। তাঁরা নিজেদের মধ্যে টুকটাক গল্প করছেন, তাঁদের মুখচোখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় না যে তাঁরা হরতাল সামলাতে এসেছেন। আল–ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের বন্ধ গেটের পাশের দেয়ালে সাঁটা রয়েছে আজকের দৈনিক সংগ্রাম-এর পাতাগুলো। তিন-চারজন কৌতূহলী মানুষ পত্রিকাটি পড়ছেন। প্রথম পাতায় মাস্ট হেডের নিচে ডানের চার কলামজুড়ে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের উক্তি: ‘আমার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে ইসলামি আন্দোলন শক্তিশালী হবে।’ ডানে তাঁর পোট্রে৴ট, নিচে, বাঁ দিকে তাঁর ছেলের ছবি, যিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে শুরু করলে যাঁরা পত্রিকা পড়ছিলেন, তাঁরা এক পাশে সরে গেলেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী মনে হয়?’ তাঁর উত্তর: ‘মনে হয় আজ রাত্রেই ফাঁসি দিয়া দিব।’ ফাঁসির ব্যাপারে তাঁর মত জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন। আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ; দারোয়ান ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। টেলিফোনে সহকর্মী সেলিম জাহিদ জানালেন, কার্যালয়টি বন্ধ আছে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে। দলটির নেতাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগ হয় টেলিফোন কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
মগবাজার থেকে আরেক রিকশায় যখন নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে পৌঁছলাম, তখন বেলা সাড়ে ১১টা। এই রাস্তায়ও হরতালের কোনো লক্ষণ নেই। সব ধরনের যানবাহন চলছে, তবে যানজট নেই। সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস, সেগুলো বন্ধ না খোলা, তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তবে লোকজনের চলাচল দেখে মনে হয়, স্বাভাবিক কাজকর্মই চলছে সবখানে। বিএনপির অফিসের নিচে অবস্থান করছেন পুলিশের বেশ কিছু সদস্য। ‘ক্রাইম পেট্রোল’ লেখা চোখধাঁধানো রঙের ভেস্ট পরা দুজন হাঁটাহাঁটি করছেন; কয়েকজন নারী পুলিশকে দেখা গেল বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরা অবস্থায়। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিএনপি অফিসের নিচে পুলিশের এমন উপস্থিতি নিত্যদিনের। তবে হরতাল উপলক্ষে আজ তাঁদের সংখ্যা হয়তো কিছু বেড়েছে। দুপুর ১২টায় দলের পক্ষ থেকে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি প্রেস ব্রিফিং হওয়ার কথা, তাই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা আসছেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছেন চতুর্থ তলায়। জামায়াতের হরতালের দিন বিএনপির প্রেস ব্রিফিং কী বিষয়ে—এই কৌতূহল নিয়ে আমিও সেই কক্ষে গেলাম। অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট সেখানে অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম রিজভীর আসার কোনো লক্ষণ নেই, তখন বিএনপি অফিস থেকে বেরিয়ে পুরানা পল্টনের দিকে রওনা হলাম। কাকরাইল মোড়ে এসে বাঁ দিকে ঘুরে বিজয়নগরের রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোনোর পর রিকশা ছেড়ে দিতে হলো। কারণ যানজট। পুরানা পল্টনের মোড়ের যানজট বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছে। হেঁটে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের বারান্দায় উঠতে হলো রীতিমতো ভিড় ঠেলে, আর দেখা গেল একটি দোকানও বন্ধ নেই। এক নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মার্কেটের লোকেরা কি হরতাল বয়কট করেছে, ভাই?’ তিনি বললেন, ‘সারা সপ্তাহ ধরে হরতাল করব? মানষের প্যাট নাই?’
জামায়াতে ইসলামীর ডাকে হরতাল শুরু হয়েছে ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে। তার আগের দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে জামায়াত দেশব্যাপী তিন দিনের হরতাল ডাকে। বৃহস্পতিবার ছিল সে হরতালের প্রথম দিন, পরদিন শুক্র ও শনিবার ছুটির দুই দিন বিরতি দিয়ে রোববার ও সোমবার আবার হরতাল। মঙ্গলবার আশুরার ছুটি। ছুটির দিনে কেউ হরতাল ডাকে না। তাই ট্রাইব্যুনাল যখন জামায়াতের আরেক নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করলেন, তখন জামায়াত হরতাল ডাকল বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে আপিল বিভাগে জামায়াতের আরেক নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল ঘোষিত হলে জামায়াত বুধবারেও হরতাল ডেকে দিল। অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে ৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার—পুরো সপ্তাহটাই পড়ে গেল জামায়াতের ডাকা হরতালের কবলে।
কিন্তু জামায়াতের এই হরতাল জনসাধারণ আগাগোড়াই প্রত্যাখ্যান করেছে। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের একাধিক দোকানি আমাকে বললেন, শুধু জামায়াতের নয়, কোনো দলের ডাকা হরতালই তাঁরা সমর্থন করেন না। একজন তো জোর দিয়ে বললেন, আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করার সময় হয়েছে। এ দিনের খবরের কাগজে দেখলাম, ব্যবসায়ী নেতাদেরও কেউ কেউ এমন দাবি তুলেছেন। কিন্তু হরতাল তো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। এটা নিষিদ্ধ করতে যে আইন করা হবে, সেটা হবে গণতন্ত্রবিরোধী একটা কালাকানুন। আমার এ রকম যুক্তিও নাকচ করে দিলেন এক দোকানি। তিনি বললেন, ‘গণতন্ত্র রাখেন। আগে বলেন, আমার রুজিরোজগারের সমস্যা করার অধিকার কি আপনার আছে? হরতাল দিয়া দলগুলা আমাগো দোকান খুলতে দিব না, রাস্তায় গাড়ি নিয়া বার হইলে গাড়িতে আগুন দিব, বোমা মারব—এইটা যদি গণতন্ত্র হয়, তাইলে সেই গণতন্ত্রের দরকার আমাগো নাই।’
এক দোকানি বললেন, ‘যারা হরতাল দিছে তারা তো ঘরে বইয়া রইছে, কিয়ের হরতাল?’
আমি তাকে বলি, ‘আপনি বলতে চাচ্ছেন হরতালের ডাক দিয়ে ঘরে বসে থাকা চলবে না? রাস্তায় নেমে জ্বালাও-পোড়াও করতে হবে? পুলিশের সঙ্গে মারামারি করতে হবে?’
‘আমি কমু ক্যান? যারা হরতাল দেয় তারা তো এইগুলাই করে।’
‘কিন্তু এবার তো জামায়াত-শিবির এসব কিছুই করেনি।’
‘করব কেমনে? হেরা রাস্তায় নামলেই তো পুলিশ ধইর্যা লয়া যায়।’
আমার মনে প্রশ্ন জাগে: এই লোকটি কি জামায়াতের সমর্থক? তাহলে তো ভালোই। আমি তো মনে মনে জামায়াতের সমর্থকদেরও খুঁজছি। জিজ্ঞেস করি, ‘নিজামী, কামারুজ্জামান, কাসেম আলী—জামায়াতের এই নেতাদের ফাঁসির ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?’
‘ওইসব পলিটিকস বুঝি না, স্যার, মুরুক্কু মানুষ!’
কিছুক্ষণ পরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের মাইকে বেজে উঠল জোহরের আজান। মার্কেটের বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে দেখি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মসজিদের দিকে; তাঁর মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে ধবধবে পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি, কপালে নিয়মিত নামাজ পড়ার দাগ। যে প্রশ্নটি ওই দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁকেও সেটাই জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হেরা নিচ্চয় পাপ করছে। নাইলে ফাঁসি হইব ক্যান? ভালা মানষের ফাঁসি হয়?’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
[email protected]