'কাইন্দো না রহমতের মা'

২০০৬ সালের ২২ মার্চ মধ্যরাতে আমার ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ গানের মিউজিক ভিডিওর শুটিং শেষ করে কালো ট্যাক্সিতে ঢাকার বনানী থেকে ফিরছিলাম ইন্দিরা রোডের বাসায়। সেই সময় ট্যাক্সি-সিএনজি অটোরিকশার চালকের সঙ্গে ছিনতাইকারীরা যোগসাজশ করে যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে আহত করে অচেনা জায়গায় ফেলে রেখে যেত। সেই ভয় থেকে সেদিন আমি ট্যাক্সিচালকের পাশের আসনেই বসেছিলাম, সিটবেল্ট ছিল না। বিজয় সরণি পেরিয়ে ডানে মোড় নিয়ে সামনে এগোলে রোকেয়া সরণির মুখে ঊর্ধ্বমুখী উড়োজাহাজের ভাস্কর্য, তার নিচে একটা সংকেত চিহ্নবিহীন সড়ক বিভাজক। সামান্য দূর থেকেও ওটাকে দেখা যায়নি, হঠাৎ সেটা চোখে পড়ল, কিন্তু তখন কিছুই করার রইল না। আমি সামনের কাচ ভেঙে ছিটকে পড়লাম, আমার বাঁ চোখে ভাঙা কাচের টুকরা ঢুকে গেল। আমি চোখটা হারালাম। আমার বন্ধু, নিকটতাত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা দুঃখ করে বলেছিলেন, আমার ওপর রহমত ছিল না।

কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন একেবারেই অন্যভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সিদ্দিকুর রহমান তাঁদের একজন। ভিডিও চিত্রে পরিষ্কার দেখা গেছে, সিদ্দিকুর পথে লুটিয়ে পড়েছিলেন পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতেই। কিন্তু পুলিশ বলল, শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ফুলের টব ছুড়ে মেরেছিলেন, সেই টবের আঘাতেই সিদ্দিকুরের চোখ জখম হয়েছে। চিকিৎসকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সিদ্দিকুরের দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সরকার তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাবে বলেছে, ঠিক আছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়; পুলিশের এই অকারণ বাড়াবাড়ি ও ফুলের টবের গল্প প্রচারের শাস্তিও হওয়া দরকার। মুখে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কথা বলা হবে, আর বাস্তবে জবরদস্তি, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, জবাবদিহিহীনতা ও মিথ্যাচার চলবে—এটা গণতন্ত্র নয়।

সরকার কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা জবাবদিহির প্রয়োজনই বোধ করেন না। শাসকগোষ্ঠীর আচরণ জবরদস্তিমূলক; কথাবার্তায় সবাইকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্তই হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সংস্থার প্রশংসা এবং সমালোচনা করার স্বাধীনতা থাকবে। ভালো কাজ, উন্নয়ন, সামাজিক সমৃদ্ধি যেমন প্রশংসা ও সহযোগিতা পাওয়ার দাবি রাখে, তেমনি যেকোনো নেতিবাচক ভূমিকা, পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তও সমালোচনার যোগ্য। গণতন্ত্রের এটুকু ধারণা উপলব্ধি করার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

বদ্ধ জলাশয়ে শেওলা জমে; আবর্জনা, পূতিগন্ধময় জলজ হাওয়া ঘুলিয়ে তোলে চারপাশ। আর প্রবহমান নদী, যে সাঁতার জানে না, তাকেও ভাসিয়ে রাখে। আমরা আমাদের নদীগুলোকে খুন করে চলেছি। বৃষ্টির জমাট জল পথ খুঁজে নদীতে বা খালে মিশে সমুদ্রে যাবে, সেই পথ আমরা অপরিকল্পিত আবাসন-লিপ্সায় রুদ্ধ করেছি। নোংরা পরিবেশে, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার জলাবদ্ধতায় মশার বিস্তার। ‘চিকুনগুনিয়া’ নামের ভয়ানক যন্ত্রণাময় জ্বরে ভুগছেন অনেক মানুষ। অদৃষ্টবাদের চর্চা চালু করে জনরোষ খানিকটা প্রশমিত করা যেতে পারে, কিন্তু ‘উন্নয়ন’ নামের নাট্যমঞ্চটিও যে আলোহীন ভুতুড়ে দেখায়!

জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে খুবই জরুরি কয়েকটি কথা বলেছেন। উন্নয়নের ধারণা সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাকে তালিকা পাঠাও। কার ঘর নেই। আমি সবাইকে ঘর করে দেব। অথবা বলেন, বিধবা ভাতা দেব বা নিঃস্ব ভাতা দেব। এগুলো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এগুলো কিছুটা উপশমমূলক। রোগের কারণে হাত দেওয়া হচ্ছে না। রোগের কারণটা হচ্ছে উন্নয়ন ধারার মধ্যে যে ধনীদের প্রতি পক্ষপাত, কৃষক বা শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রভৃতি বিষয়, এসব গভীর বিষয়ে হাত না দেওয়া। পরিবর্তন না আনা হলে শুধু উপরে ভাসা ভাসা কিছু কর্মসূচি দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না।’ (বণিক বার্তা, ২০ জুলাই ২০১৭)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ৪৫ বছর হেঁটে দৌড়ে বাংলাদেশ কতটুকু এগোল? ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রক্তস্নাত বিজয়ী জাতির সংবিধানে এখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। গণতান্ত্রিক ও সম–অধিকারের যে সমাজকাঠামোর স্বপ্নে লাখো মানুষ শহীদ হয়েছিল, সেই সমাজ এখন চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরতান্ত্রিক। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রগতিশীলতা ধারণ করা যায় না, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতা লালন করা যায়। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীরা কেন খুন হয়েছিলেন, তা খুব স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায় পটুয়া কামরুল হাসান পাঠে। তিনি বলেছেন, ‘...বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতারা তো সুযোগ পেলেই শিল্পী-সাহিত্যিকদের সরাসরি “মেরুদণ্ডহীন” গোষ্ঠী বলে গালাগাল দিতেও দ্বিধা করেন না। তাঁরা চান তাঁদের মতামত যা-ই হোক, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাঁদের দলীয় কর্মীর মতোই অন্ধভাবে সমর্থন জুগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের শিল্পীদের এ বিষয়ে নিজস্ব চিন্তাধারা অবশ্যই আছে এবং সরাসরি দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের জীবনধারার সঙ্গে তা সম্পৃক্ত। তাই মানবতাবিরোধী যেকোনো কাজের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মনে তার প্রতিক্রিয়া হতে দেখা গেছে।’ (বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)।

এখনকার বাংলাদেশে আমাদের নীরবতার মানে কি এই যে এখানে এখন সবকিছুই মানবিক? নাকি আমরা শর্তহীন তল্পিবাহক? ফ্যাসিবাদ খুবই সর্বনাশা। ‘...যেকোনো ধনতন্ত্রেই উদ্ভূত হতে পারে ফ্যাসিবাদ, যেখানে আপাত-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধনতন্ত্রকে রক্ষা করতে অপারগ হয়ে ওঠে। অবশ্য এর পেছনে সামাজিক এবং জাতীয়তাবাদভিত্তিক সমর্থন থাকতেই হবে। যেখানে কর্মহীনতা প্রবল, জাতীয়তাবাদ জঙ্গি, সাবেকি অর্থনীতি দেশের গরিষ্ঠ অংশের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, সেসব স্থানে ফ্যাসিবাদ চড়াও হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়। শিল্পসাহিত্য তখন রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে দাঁড়ায়।’ (ফ্যাসিজম: নিত্যপ্রিয় ঘোষ)।

লেখার শুরুতে আমার বন্ধু-স্বজনদের মুখে রহমতের কথা বলেছিলাম। আওয়ামী লীগের এক সাংসদ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি র‌্যাবের একটি অর্থ ঠিক করেছি। র‌্যাব হচ্ছে রহমত অব আল্লাহ ফর বাংলাদেশ।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ১৬ জুলাই)।

মনে পড়ছে, ফকির আলমগীর অনেক আগে ‘কাইন্দো না রহমতের মা’ শিরোনামে একটি গান করেছিলেন।

আচ্ছা, বাংলাদেশ কি একটু কাঁদবে? শিক্ষার্থী সিদ্দিকুরের কথা ভেবে? আমাদের এইসব দিনরাত্রির কথা ভেবে?

 মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।