'কেয়া বাত' এবং ঘোর অন্ধকার

আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন: চিরতরে ধ্বংস করা হলো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই উপকরণগুলো
আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন: চিরতরে ধ্বংস করা হলো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই উপকরণগুলো

সাবলীলভাবে বাংলা বলে অদিতি। শব্দচয়ন থেকে বাক্য গঠন, চারপাশে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল। বসার ঘরে বসেছিলাম আমরা—আমি, বন্ধু গিটারিস্ট কিবরিয়া ও অদিতি। কাচের জানালার একটা অংশ খোলা ছিল। কনকনে উত্তুরে বাতাস সেদিক দিয়ে ঢুকে ঘরের ভেতরে শৈত্য ছড়াচ্ছে অনুভব করে অদিতিকে বলি, ‘জানালাটা টেনে দাও।’ অদিতি হরিণ পায়ে জানালার কাছে গিয়ে খোলা অংশটা টেনে এনে বন্ধ করে। ‘আজ সূর্য দেরিতে উঠেছে তো। ঘোর অন্ধকার হয়ে ছিল ঘরটা।’ বাক্য শেষ করে আবার নিজের বসার জায়গায় ফেরে অদিতি। এবার সংশোধনী দেয় সে। ‘না, সূর্য ঠিক সময়েই উঠেছে। আকাশে মেঘ ছিল।’ দাঁত বের করে হাসে মেয়েটি। আর আমার কানে গুঞ্জরিত হতে থাকে ‘ঘোর অন্ধকার’ শব্দটি। দ্যুতিময় চোখ মেলে অদিতি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বায়না ধরেছে এবং আনন্দিত অপেক্ষা করছে, কখন তার অনুরোধ করা গানটি আমি গেয়ে শোনাব। সচরাচর যে গানগুলোর জন্য অনুরুদ্ধ হই, অদিতি সেই পথে হাঁটেনি। এই গানটি এখনো কোনো স্টুডিওতে রেকর্ড করিনি। টেলিভিশনে সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে তিন-চারবার হয়তো গেয়েছি।
‘আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি, তখন শুনেছিলাম। শুনে আমার কান্না পেয়েছিল। ওই যে, ফুটপাতে একটা বাচ্চা শুয়ে থাকে, তার বাবা-মা নেই, অনেক শীত, জামা নেই আর এখন চাঁদ উঠেছে।’ অদিতি বিরতিহীন বলতে থাকে। আমি কিবরিয়ার চোখে চোখ রাখি। কিবরিয়া বহুদিন আমার গানের সঙ্গে গিটার বাজায়। আমাদের চোখগুলো ভেসে যেতে চায় অদিতির মমতার সঙ্গে। অদিতি এখন ক্লাস ফোরে পড়ছে।
অথচ আমাদের চারপাশে ঘটে চলা অনেক ঘটনার মাঝে একটি অগ্নিকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, গুমরে গুমরে কাঁদছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একেকজন দিকপাল। কে নেই প্রশ্নকর্তাদের মাঝে? পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, ওস্তাদ রশিদ খাঁ, পণ্ডিত যশরাজ, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি এবং ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর পুত্র ওস্তাদ আশীষ খাঁসহ অসংখ্য গুণীজন। হতবিহ্বল হয়েছেন ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসাছাত্রদের হাতে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এ ঘটনাকে তাঁরা দেখছেন ২০০১ সালের আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের পর শিল্প-সংস্কৃতির জগতের ওপর নেমে আসা সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ হিসেবে। মাইহার ঘরানার প্রবক্তা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে এবং সুযোগ্য শিষ্যা অন্নপূর্ণার কাছে শিক্ষা নেওয়া পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া বেদনার্ত হয়ে বলেছেন, ‘এটা মানবতার মৃত্যু। ওই ধরনের ঘটনা সামাজিক কাঠামোকেই বিপর্যস্ত করে। কাল তো জনতা উত্তেজিত হয়ে সংগীতশিল্পীদেরও আক্রমণ করতে পারে। ওরা আমাকেও মেরে ফেলতে পারে।’
পণ্ডিত যশরাজের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়মাখা, ‘বাংলাদেশ সংগীত এত ভালোবাসে। সেখানে এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? হামলাকারীরা কোনো ভুলপথে চালিত হয়েছে। কী ধ্বংস করছে, ওরা তা জানত না।’
ওস্তাদ রশিদ খাঁ সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে মনুষ্যত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, ‘মানুষ কীভাবে এতটা নিচে নামতে পারে! শিল্পীরা সব জায়গাতেই সহজ নিশানা হয়ে যাচ্ছেন। মৃতদের স্মৃতিকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’ ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের আসার কথা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘সংগীতাঙ্গনে’। অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ তাঁকে হকচকিত করেছে। তিনি বলেছেন, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাহিবের মাইহার ঘরানার শিল্পী আমি। তাঁর সব স্মৃতি এভাবে ছাই হয়ে গেছে জেনে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে। বামিয়ান বুদ্ধমূর্তির ওপর তালেবান হানার মতোই ভয়াবহ এই ঘটনা।’ আর ঝলসে উঠেছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর ছেলে আশীষ খাঁ। বলেছেন, ‘এটা লজ্জাজনক ঘটনা। আসলে বাংলাদেশ কখনোই দাদুকে যোগ্য সম্মান দেয়নি। মর্মাহত বোধ করছি। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক সরকার।’ উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য এসব শিল্পী তাঁদের ক্ষোভ ও কান্না ব্যক্ত করেছেন কলকাতার অনলাইন সংবাদপত্র ‘এই সময়’-এর ১৯ জানুয়ারি সংখ্যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পজগৎ নিশ্চুপ। এত বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেল, কোনো প্রশ্ন নেই। প্রতিবাদ নেই। সরবে না। ফিসফিস করেও না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা টুঁ শব্দ করল না। শিল্পকলা একাডেমিও না। বুঝলাম, এরা সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারকে অসন্তুষ্ট করতে পারবে না তারা। কিন্তু অন্যরা? একসময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। তার প্রতিবাদে শিল্পবোধ নিয়ে ঝলসে উঠেছিল মুক্তমনা মানুষ, ‘ছায়ানট’-এর যাত্রা সূচিত হয়েছিল, ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিল ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’। উপমহাদেশের আর এক মহান সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদার গড়ে তুললেন ‘ঢাকা মিউজিক কলেজ’। তারপর স্বাধীন দেশে আরও কত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। নৃত্যকলা, সংগীত, নাটকের দল—সবাই মিলে কী তরঙ্গই না তৈরি করেছিল সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার অবসানকল্পে সৃজনশীল নির্মাণে। উদীচী, ক্রান্তি, খেলাঘর, গণশিল্পী সংস্থা, চারণ, ঋষিজ—আরও কত নাম! সংবেদনশীলতায় পাদপ্রদীপের আলো জড়িয়ে জীবনের উচ্চারিত সত্য নিয়ে সারা দেশে বিস্তার নিল বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, চারুশিল্পী সংসদ। এত বড় নারকীয় একটা ধ্বংসযজ্ঞে আমরা কেউ টলে উঠলাম না। জ্বলে উঠলাম না। আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি চেতনা এখন সুদূর অতীত কেবল?
কিন্তু মাত্র তিন মাস আগে রাজধানী ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পাঁচ রাত জেগে হাজার হাজার মানুষ উচ্চাঙ্গসংগীতের রস আস্বাদন করেছিলেন, আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের এটা ছিল চতুর্থ আয়োজন। মনে পড়ছে, তৃতীয় আয়োজনের উদ্বোধনী মঞ্চেই কথা বলতে বলতে শেষ নিশ্বাস ফেলেছিলেন পুরোধা চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, তবুও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি। ও রকম একটি শোককে শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধাবনত আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং শ্রোতা-দর্শক হৃদয় প্রসারিত করে শিিল্পত করে তুলেছিলেন সেদিন। ‘সংগীতাঙ্গন’ পোড়া গন্ধ আজ বিস্ময়করভাবে সেই সব হৃদয়ের নাগাল পেল না।
২০১৫ সালের চতুর্থ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এক রাতে সর্বোচ্চ শ্রোতা-দর্শক সমাগম হয়েছিল নাকি ৪৫ হাজার। গণমাধ্যমে এই সংবাদ আনন্দের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল। সংগীতের এই উঁচু স্তরের পরিবেশনায় এত মানুষের অংশগ্রহণ উৎসবে আমন্ত্রিত ওস্তাদ ও পণ্ডিত গাইয়েদেরও প্রশংসা পেয়েছিল। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মানুষের রুচি ও গুণীর কদর করার মানসিকতা দেখে তাঁরা আপ্লুত হয়েছিলেন। কিন্তু আজ তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, বছরের পর বছর যে প্রতিষ্ঠান উচ্চাঙ্গসংগীতের সফল আয়োজন করে চলেছে শিল্পপ্রেমে, তারা কেন একদল উগ্র ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে দাউ দাউ পুড়তে থাকা কিংবদন্তিতুল্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরোদের কান্না শুনতে পেল না? আর সেই যে রাতজাগা ‘কেয়া বাত, কেয়া বাত’ উচ্চারণকারী সমঝদার ৪৫ হাজার শ্রোতা-দর্শক, তাদের এক ভাগও অর্থাৎ ৪৫০ জন ক্ষুব্ধ মানুষও কেন একটি প্রতিবাদের সমাবেশ করতে পারলাম না অথবা চাইলাম না।
১৯৫৬ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতের বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ষাটের দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, দুর্লভ আলোকচিত্র সংগ্রহ করে স্মৃতি জাদুঘরের কাজ এগোতে থাকে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘর। ‘সংগীতাঙ্গনে’ এবং জাদুঘরে কী কী ছিল? ছিল আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত দুটি সরোদ, দুটি বেহালা, একটি সন্তুর, সারেঙ্গি ও পাখওয়াজ, চারটি তানপুরা, বেশ কয়েকটি বাঁশি, রেওয়াজের জন্য মাইহারের নবাবের দেওয়া দুটি কার্পেট, নিজের হাতে লেখা ২৫টির বেশি চিঠি, হজে যাওয়ার সময় সৌদি সরকারের দেওয়া দুটি জায়নামাজ, মেয়ে
অন্নপূর্ণা দেবী, ছেলে আলী আকবর এবং জামাতা রবিশঙ্করসহ দুর্লভ একেকটি আলোকচিত্র—সব পুড়ে গেছে, ছাই করে
দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই উপকরণগুলো চিরতরে হারিয়ে গেল।
যে রবীন্দ্রনাথ মার্জিত বাঙালির আভিজাত্যের প্রতীক, যাঁকে ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি অনেকটাই মরুভূমির মতো নিষ্প্রাণ, সেই মহাপ্রাণও আর্দ্র হতো আলাউদ্দিনের সুরেলা গভীরতায়। ‘...রবীন্দ্রনাথের তখন পরিণত বার্ধক্য, সব উৎসব-অনুষ্ঠানে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না সব সময়, তবু অসুস্থ শরীরেও যে সেবার “বর্ষামঙ্গল” অনুষ্ঠানে (৩০ শ্রাবণ ১৩৪২) উপস্থিত হয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ সেই অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন আলাউদ্দিন। এই সুর সাধকের সংগীত সম্পর্কে কবির এতটাই প্রীতি ছিল যে তিনি আলাউদ্দিনকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে।...রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসুকে: “আলাউদ্দিনের মাথাটা রেখে দাও।” আচার্য নন্দলালের সুযোগ্য ছাত্র রামকিঙ্কর বেজ ধরে রেখেছিলেন আলাউদ্দিনের মাথা, ভাস্কর্যে!...’ (আলাউদ্দিন-আলপনা রায়)।
রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে ব্যাকুল এই আমরা, আলাউদ্দিন-পরবর্তী উচ্চাঙ্গসংগীত শুনে ‘কেয়া বাত’ বলি ঠিকই, কিন্তু ক্লাস ফোরে পড়া বগুড়ার অদিতি অতন্দ্রিলার মতো নিষ্কলুষ চোখে সমকালীন ‘ঘোর অন্ধকার’ দেখতে পাই না।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]