'খিলাফত' থেকে আইএস বিতাড়নই সব নয়

২০১৪ সালের গ্রীষ্মে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভ্যান্ট’ (আইএসআইএল বা আইএসআইএস বা আইএস) মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পটভূমি ও মানচিত্র পাল্টে দেয়। ১০ জুন, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্ব জানতে পারে, মসুল আইএস নামে এক উগ্রবাদী ইসলামি দলের দখলে চলে গেছে। এর বেশ কিছু মাস পর খবর পাওয়া গেল যে চরম ইসলামপন্থী ও সব আল-কায়েদা সম্বন্ধযুক্ত দলগুলো বাগদাদের কাছের শহর ফালুজা থেকে শুরু করে তুরস্ক-সিরিয়া সীমানার নিকটবর্তী শহর রাকা পর্যন্ত দখল করেছে। দখল করা এই অঞ্চলকে তারা ‘খিলাফত’ বলে দাবি করে। এই অঞ্চল একসময় ওসামা বিন লাদেনের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে আকারে কয়েক শ গুণ বড়।

বিশ্বজুড়ে নারী কিংবা অভিবাসী বিষয়ে সমালোচিত বা কুখ্যাত হলেও আইএস বিষয়ে তাঁর পদক্ষেপ স্পষ্ট। তিনি রাশিয়ার ওপর এই বৈশ্বিক শত্রু নির্মূলের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। ওবামা সরকারের কাছে আইএস নির্মূলের চেয়ে কার্যত সিরিয়া থেকে আসাদ সরকার বিদায়ের বিষয়টিই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আসাদবিরোধীদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে প্রশিক্ষিত করে তুলতে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে কংগ্রেসের কাছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়েছিলেন। এই ঘোষণার ছয় মাসের মাথায় তাঁরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বাইডেন স্বীকার
করেন যে আসাদবিরোধী শক্তিগুলো আসলে আইএস ও আল-নুসরা দ্বারা পরিচালিত। ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে আইএসের মসুল দখলের আগে, ইউরোপীয় বিমান তাদের বাগদাদযাত্রা বন্ধ করে দেয়। কারণ, তাদের ভয় ছিল যে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে বিমানবিধ্বংসী মিসাইল আছে, যা আসাদবিরোধীদের দেওয়া হয়েছিল। ওবামা চরমপন্থী আইএসের বিরোধিতা করলেও তাঁর সময়েই আইএসের উত্থান ও বিস্তার হয়।

অপর দিকে ট্রাম্পের কাছে সিরিয়া যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাঁর মতে, আসাদকে অপসারণ করে ভিন্ন কোনো সরকারকে ক্ষমতায় বসানো সমস্যার সমাধান নয়। কারণ, নতুন সেই সরকার যে মার্কিন মিত্র হবে তা বলা সম্ভব নয়। উল্টোটাও হতে পারে। সিরিয়ার পরিণতি ইরাক, লিবিয়া বা মিসরের মতোও হতে পারে। তাই তিনি এই যুদ্ধে আর কোনো ধরনের বিনিয়োগের পক্ষপাতী নন। এমনকি তিনি ক্ষমতায় আসার পর, জানুয়ারিতে সিরিয়াসংকট সমাধানে কাজাখস্তানে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উচ্চপদস্থ কাউকে পাঠাননি। কাজাখস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।  

ইরাকি বাহিনী মসুলের পূর্বাঞ্চল থেকে আইএস বিতাড়িত করার পর এখন পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে। বিপদের দিক হচ্ছে, ওই সব অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। আইএসের দখল করা ইরাকি অঞ্চলগুলো মুক্ত করাই কেবল এই যুদ্ধের বিজয় নয়। বিপদ হচ্ছে আইএস আদর্শে যারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে, যারা নিজেদের বা মুসলমানদের ওপর বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া অন্যায়-অবিচার ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং তারা প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে। এরা সামরিক অস্ত্র ব্যবহার ও রণকৌশলে পারদর্শী এবং তারা ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। আইএস তাদের নৃশংসতার জানান দিতে যে ভিডিও বার্তা ছাড়ে, তাতে ২১ জন মিসরীয় খ্রিষ্টানের শিরশ্ছেদের চিত্র ছিল। এই মিসরীয়রা ছিল কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরা ও পেছনে কয়েদিদের মতো হাত বাঁধা। এমনই কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরা ও হাত বাঁধা কয়েদিদের ওপর আমেরিকানদের নির্মম অত্যাচারের ছবি দেখা গেছে ২০০৪ সালে। এই আবু গারাইবের অত্যাচারিত বন্দীদের কথা ভুলে গেলে বা উপেক্ষা করলে আইএসের উদ্দেশ্য ও নৃশংসতা সম্পর্কে বোঝা যাবে না। আইএসের অনেকেই আবু গারাইব
বা ক্যাম্প বুকা থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দী। বলা যায়, ক্যাম্প বুকায় আমেরিকার চোখের সামনে বন্দীরা আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। একই জায়গায় চরমপন্থী ও সাধারণ বন্দীদের রাখা হয়েছিল। এই ক্যাম্পেই বাগদাদি আটক ছিলেন, ছাড়া পাওয়ার পর তিনি তাঁর ক্যাম্পের সহযোগীদের দলে ভেড়ান।

বারাক ওবামা যখন ক্ষমতায় আসেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিভাবে দুটি যুদ্ধে জড়িত ছিল। প্রলম্বিত এই যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ ৪ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনার মৃত্যু ঘটে। যুদ্ধ বন্ধ করা ও ইরাক, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করা ছিল বারাক ওবামার ক্ষমতায় আসার ম্যান্ডেট। শত্রু দমন না করে ফিরে আসায় অনেকেই তাঁকে আমেরিকার নিরাপত্তা বিষয়ে আপসকারী মনে করলেও তাঁর আমলে সবচেয়ে বেশি সাধারণ জনগণ হত্যা ও শরণার্থীসংকট হয়। চালকবিহীন অনৈতিক ড্রোন হামলা হয় সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে, মসজিদে, স্কুলে, হাসপাতালে, এমনকি বিয়েবাড়িতেও। এসব হামলার প্রকৃত চিত্র কিছু উইকিলিকসের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, আর কিছু হয়তো মার্কিন নথিপত্রে আছে, কিংবা ধ্বংস করা হয়েছে। যেভাবে ৯/১১ কমিশন রিপোর্টে ২৮ পৃষ্ঠাজুড়ে হামলাকারীদের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের যে বর্ণনা ছিল, তা মূল রিপোর্ট থেকে কেটে ফেলা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে কখনোই তা প্রকাশ করা হয়নি।

ইরাকের মসুল, সিরিয়া বা নিজেদের ঘোষণা করা ‘খিলাফত’ থেকে আইএস বিতাড়িত হলেই সমস্যার সমাধান হবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যেভাবে তালেবান থেকে আল-কায়েদা ও আল-কায়েদা থেকে আইএসের জন্ম, একইভাবে ইরাক ও সিরিয়া থেকে উৎখাত হওয়া আইএস আদর্শের মানুষগুলো কোথাও না কোথাও, কারও না কারও দ্বারা, কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতেই থাকবে। বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসছে—এমন কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না। বরং উল্টো লক্ষণগুলোই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলছে। দেশে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত বা শোষণ ও আগ্রাসনের অবসান হতে যাচ্ছে—এমন আশাবাদ যেহেতু করা যাচ্ছে না, তাই নতুন কোনো নামে হোক বা ভিন্ন রূপে হোক, এ ধরনের বিভিন্ন দল জন্ম নিতেই থাকবে। 

আইরিন খান: গবেষক।