'তুরাগ হত্যা মামলা' এবং নদী নিয়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ

তুরাগ নদ ভরাট করে বালুর ব্যবসা। ছবি: প্রথম আলো
তুরাগ নদ ভরাট করে বালুর ব্যবসা। ছবি: প্রথম আলো

আদালত এবার আর রেখেঢেকে কোনো কথা বলেননি। যাঁরা নদী গিলছেন, আস্ত নদীকে দিনেদুপুরে গুম বা খুন করে দিচ্ছেন, তাঁদের চিনতে কোনো তকলফি হয়নি বিচারকদের। এই নদী-ধর্ষকদের পা বড় হতে হতে যে সংসদ ভবন পর্যন্ত চলে যায়, যাচ্ছে, তাও বিলক্ষণ অনুধাবন করে আদালত তাঁদের জন্য আইনসভা আর কোষাগারের (ব্যাংক) দরজা বন্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যেই কেল্লা ফতে করেছেন, মধ্যরাতে আলো-আঁধারির পথ ধরে শপথ নিয়ে ফেলেছেন বা হাতে মোচড় দিয়ে কিংবা তোষামোদির তেলে সংশ্লিষ্টদের তাতিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ করে ঘি খাচ্ছেন, তাঁদের কী হবে? তাঁরা তো আদালতের রায়ের মর্ম বুঝে স্বেচ্ছায় কিছু করার বান্দা নন, তাহলে তাঁদের পথের দিশা কে দেবে? নদী কমিশন? নদী কমিশনের গদিনসীনদের মাজায় কি সেই জোর আছে? জোর থাকলে কি গদি পেতেন? এসব প্রশ্নের ঘূর্ণি চাকায় ঘুরবে দেশের আমজনতা।

তবে আদালতের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে রায়ের শেষে তুরাগসহ দেশের সব নদীকে ‘জীবন্ত মানবিক সত্তা’ বলে ঘোষণা করেন। ‘জীবন্ত মানবিক সত্তা’ মানে কী? কী তার অর্থ-তাৎপর্য-দ্যোতনা?

জীবন্ত মানবিক সত্তার মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে নদী যে একটা জীবন্ত মানুষের মতো মানবিক অধিকারের ধারক, সেটা মেনে নেওয়া। একটা মানুষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেমন তার মতামত, ভালো-মন্দের দাম দিতে হয়, নদীর ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে। নদীর কথা বলার আগে নদীর কথা শুনতে হবে। নদীর পাড় বাঁধতে হলে, নদীর বুকে গ্রোইন তুলে নদীকে দিগ্ভ্রান্ত করতে হলে, নদীর পানি তুলে অন্য কাজে ব্যবহার করতে হলে নদীর অনুমতি নিয়ে সেটা করতে হবে। যে-কারও হাত ধরতে চাইলে যেমন তাঁর ইচ্ছা আর ভালো লাগা বা না লাগার ধারাবাহিক খোঁজ রাখাটা জরুরি, নদীতে হস্তক্ষেপের আগেও নদীর সেই ইচ্ছার খবর আমাদের রাখতে হবে।

মনে রাখা দরকার, নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা আমাদের কানে নতুন নতুন লাগলেও পৃথিবীতে এর অনেক উদাহরণ আছে। অনেক আগে নিউজিল্যান্ডের হোয়াংগানুই নদীকেও একজন জীবন্ত মানুষের মতো মানবিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। হালে (মার্চ ২০১৭) ভারতের গঙ্গা ও যমুনা নদীকে ‘জীবন্ত মানুষের’ অধিকার দেন সে দেশের আদালত। উত্তরাখন্ডের হাইকোর্ট তাঁদের এক রায়ে এই দুই নদীকে ‘জীবন্ত মানবিক সত্তা’ হিসেবে গণ্য করে তাদের সংরক্ষণ এবং দূষণ থেকে রক্ষা করার নির্দেশ জারি করেন। জীবন্ত সত্তা হলে কী হবে, নদী তো আমাদের ঢঙে ধরনা-আন্দোলন-মিছিল করতে পারে না। নদীর ভাষা ভিন্ন। তাহলে কে হবে তার দোভাষী বা অভিভাবক? উত্তরাখন্ডের আদালত সেই রাজ্যের দুজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে এই দুটি নদীর আইনগত অভিভাবক নিয়োগ করেছেন। আদালত এই দুজনের জন্য তাঁর দরজা কেয়ামত পর্যন্ত খোলা রেখেছেন। মামলার বোঝা আর চাপ যত বেশি হোক, নদী সুরক্ষা আর দূষণমুক্তির কোনো কাজে গাফিলতি হলে আদালতকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আদালত তারিখের পর তারিখ পিছিয়ে নদীর দম বন্ধ হতে দেবে না। আমাদের আদালত এবারের রায়ে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় রক্ষার আইনগত অভিভাবকত্ব দিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়রে সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সব দায়িত্ব পালন করবে নদী রক্ষা কমিশন।

কিন্তু কীভাবে?
আদালত মামলা-জটের দড়িতে নদীকে মরতে দিতে রাজি নন। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে খুবই খোলসা করে বলেছেন, নদী রক্ষা কমিশন মানবাধিকার রক্ষা কমিশনের ‘ডামি’ হলে চলবে না। জটের পাহাড়ে জমে থাকা পাঁচ লাখ মামলা, নিষ্পত্তিতে ৩০ বছর লেগে যাবে। এই কমিশনগুলো সঠিকভাবে কাজ করলে অনেক বিষয় আদালতে আসতই না। নদী রক্ষা কমিশনের যদি কিছু করার মতো কাজ না থাকে, তাহলে মানবাধিকার কমিশনের মতো এটাও (নদী রক্ষা কমিশন) কি ডামি?

স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নদী রক্ষা কমিশন যাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে রায়ে সরকারকে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে:

১. নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে।

২. নদ-নদীর পাশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। বিষয়টি সরকাররে সব বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

৩. স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত ও নির্ণয় করে একটি ডিজিটাল ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে। সেই ডেটাবেইস দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

৪. যেকোনো নাগরিক যেন নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নদ-নদীর ম্যাপ, তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

আদালত আরও বলেছেন,

ক. প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তা পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।

খ. কোনো ব্যক্তির ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি তাঁর নাম নদ-নদী দখলদারের তালিকায় থাকে, তাহলে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।

গ. নদ-নদীর পাশে কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে নদী রক্ষা কমিশন থেকে অনাপত্তি নিতে হবে।

ঘ. নদী রক্ষা কমিশনকে কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হলো।

ঙ. সব স্কুল, কলজে, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতে প্রতি দুই মাসে এক ঘণ্টার জন্য নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তা, নদ-নদীর দূষণ সম্পর্কে পাঠদান করতে হবে।

চ. দেশের ছোট-বড় সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের অংশগ্রহণে দুই মাসে অন্তত এক ঘণ্টার নদী-সংশ্লিষ্ট বৈঠক করতে হবে।

আদালত একপর্যায়ে তাঁদের রায়ের একটা সত্যায়িত অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যেন দপ্তরটি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। আদালত বুঝতে পরেছেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কানামাছি বন্ধ হবে না। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশ ছাড়া কেউ নিজ গরজে কোনো কাজ করে না। নদী রক্ষা কমিশনকে প্রতিটি উপজেলা, জেলা ও বিভাগে একটি করে নদী রক্ষা কমিটি গঠন করার কথা। এর কয়টা গঠিত হয়েছে? কোথায় কয়টা সভা হয়েছে, সব জেলা কমিটির মতো এই কমিটিরও সভাপতি জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসক অতিমানব হলেও জেলায় এযাবৎ গঠিত সব সভায় বছরে শুধু একবার করে উপস্থিত থাকাটাও প্রায় অসম্ভব। তাই তাঁরা বাধ্য হন এক সভায় যতগুলো সম্ভব কমিটির সভা শেষ করে হাঁফ ছাড়তে। হাঁফ ছাড়া জাতীয় মিটিং দিয়ে নদী রক্ষা কমিটির কাজ চলবে না।

বিধান অনুযায়ী বগুড়ার জেলা প্রশাসক জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। তাঁর চোখের ওপরেই তাঁরই কার্যালয়ের সামনে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দখল করা হয় করতোয়া নদী (মার্চ, ২০১৮)। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগের ডিসি নদী দখলের এই কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নতুন জেলা প্রশাসক কেন চুপ করে থাকলেন অথবা মেনে নিলেন? কার জবাব কে নেবে? জেলা পর্যায়ের নদী রক্ষা কমিটির নেতৃত্ব বিচার বিভাগের কারও হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না? জবাবদিহি আর স্বচ্ছতার সঙ্গে নদী রক্ষার কাজে এগিয়ে আসতে না পারলে যুগান্তকারী একটা রায় শুধু দলিলেই থেকে যাবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: গবেষক লেখক