'নিমকহারামের দেউড়ি'

হোম থিয়েটারে বাজছে উর্দু গজল।
ভদ্রলোকের অনুরোধে সোফায় বসতেই তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘গানের গলাটা চিনেছেন?’ না, চিনতে পারিনি আমরা। তিনিই বলে দিলেন—‘আপনাদের দেশের শিল্পী, আমার চাচা ওস্তাদ জাকির হোসেন।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ হিন্দোলে বিপাশাকে গান শেখাতেন। চিনি তো। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।’ আমার স্ত্রী শিরীন বলে উঠল। খুশি হলেন তিনি।
ইনি সৈয়দ রেজা আলী মীর্জা। হালকা-পাতলা গড়ন, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল। চোস্ত পায়জামার ওপর হালকা সবুজ স্ট্রাইপ কাপড়ের পাঞ্জাবি পরা, স্যান্ডেলটাও তেমন কিছু নয়, সাধারণ। কিন্তু মানুষটা অত সাধারণ নন।
খুব ছোটবেলা থেকে একটা সময় পর্যন্ত কেউ দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করলে যখন বলতাম, মুর্শিদাবাদ, সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নকর্তা বলে বসতেন, ‘মীরজাফরের দেশের লোক!’ শুনে খারাপ লাগত, তাই পরে এমন প্রশ্নের উত্তরে আমি নিজেই বলে দিই আগে, ‘ভাই, আমি মীরজাফরের দেশের লোক।’
তো সেই ‘মীরজাফর’ সাহেবের বংশধর হলেন এই ৭১ বছরের বৃদ্ধ ভদ্রলোক সৈয়দ রেজা আলী মীর্জা। নওয়াব ওয়াসিফ আলী মীর্জার নাতি। সবার কাছে তিনি ‘ছোটে নাওয়াব’ হিসেবে পরিচিত। আর্থিক দুর্গতি থাকলেও সম্মানটা নওয়াবিই পাচ্ছেন বলে বোধ হলো আমার। কথার মধ্যে নওয়াবি গর্বিত ভাবটাও যেন রয়েছে, যদিও তা প্রকট নয়।
কলকাতা বেড়াতে গিয়ে মনে হলো মুর্শিদাবাদের নওয়াববাড়ি ‘হাজার দুয়ারিটা’ দেখে গেলে কেমন হয়! এক ভোরে একটা এসি কার ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের উদ্দেশে। সাড়ে সাত ঘণ্টার পথ পেরিয়ে বেলা সাড়ে তিনটায় ছোটে নাওয়াবের মঞ্জিলে পৌঁছালাম। নওয়াবি এলাকাটাকে বলে ‘কিল্লাহ নিজামত’। তার ভেতরেই একটি পুরোনো দোতলায় তিনি সপরিবারে বাস করেন। গাড়িটা থামতেই বেরিয়ে এসে সালাম জানিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন সোজা অন্দরে। তাঁর সূত্রটা আমি পেয়েছিলাম কলকাতার এক টিভি চ্যানেলের বহরমপুর প্রতিনিধির মাধ্যমে।
নানা কথাবার্তা শেষে নওয়াব সাহেব সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার সময় পকেট থেকে তাঁর নামের একটা কার্ড বের করে দিয়ে বললেন, ‘যান, ঘুরে দেখুন, এই কার্ড দেখাবেন, টিকিট লাগবে না।’
প্রথমেই ‘কিল্লাহ নিজামত’-এর পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখলাম একটা টাঙ্গা ভাড়া করে। দেখা হলো জৈন ব্যবসায়ীর ফুর্তিঘর, রানি পুকুরঘাট, মীরজাফরের পরিবারের বাসস্থান, জগৎ শেঠের বাড়ি, গুপ্তঘর, তাঁর মন্দির, সুড়ঙ্গপথ (যেটা দিয়ে ভাগীরথী নদী এপার-ওপার করা যেত) মুর্শিদ কুলি খাঁর মেয়ে মুন্নি শা’র জ্যান্ত কবর দেওয়ার স্থান, নওয়াবদের নানা বসতবাটি, মদিনা মসজিদ, চক মসজিদ, ইমামবাড়া, হলুদ মসজিদ, প্রধান প্রবেশদ্বার, ক্লক টাওয়ার এবং আরও কিছু নাম না-জানা স্থাপনা। সবশেষে হাজার দুয়ারি ভবন, নওয়াবদের প্রধান বাসস্থান। এই ভবনটি লালবাগে নির্মাণ করেছিলেন নওয়াব হুমায়ূন ঝাঁ, ১৮২৯ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত, তখনকার মূল্যে সাড়ে ১৬ লাখ টাকায়। প্রাসাদে ঘর আছে ১১৪টা, কিন্তু দরজা এক হাজার। সেই জন্যই হাজার দুয়ারি। কিন্তু আসল দরজা ৯০০, বাকি ১০০ নকল দরজা। দেখলে আসল বলে ভুল হতে বাধ্য। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর কিল্লা নিজামত থেকে মাইল খানেক দূরে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পারে খোশবাগে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর এবং তাঁর পরিবারের কবরস্থান কিল্লাহ নিজামতের পাশেই, জাফরগঞ্জে। সেখানে বাংলা-উর্দু মিলিয়ে একটা সাইনবোর্ড আছে, দর্শক নেই।
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিজামত তথা বাংলার নওয়াবিকে ধুলায় মিশিয়েছেন যে ব্যক্তি, তাঁর কবর দর্শনের কোনো কারণ থাকতে পারে কি? এর কারণেই দেশের স্বাধীনতা তো গেলই, আরও গেল নওয়াবি ক্ষমতা। ও হ্যাঁ, আসল কথাটা বলি, সিরাজের বাড়িঘর সব নাকি একসময় আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছে। নাকি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে? সন্দেহ থেকেই যায়! কিন্তু দর্শক থাক আর না থাক মীরজাফরের কবরটা ঠিকই আছে।
শেষ কথাটা বলি, বিদায় নেওয়ার সময় ছোটে নাওয়াব তাঁর দেয়ালে ঝোলানো দুটো ছবি বিশেষ করে দেখিয়েছিলেন আমাদের। একটি পোর্ট্রেট হুমায়ূন ঝাঁর, তাঁর পূর্বপুরুষ। অন্যটি বিবর্ণ ফটো—ইস্কান্দার মীর্জার—তাঁর চাচা—পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট (গণতন্ত্র হত্যাকারী!)।
একেবারে ফেরার মুখে টাঙ্গাওয়ালা মীরজাফর আর তাঁর পরিবারের কবরের পাশ দিয়ে আসার সময় বলল, ‘নামবেন, স্যার?’
মাথা নেড়ে বললাম, ‘না’।
‘কেউ নামে না স্যার, এখানে। এটাকে সবাই বলে নিমকহারামের দেউড়ি। থু থু দেয়।’
চমৎকার নাম, একেবারে যোগ্য নাম।
একবার সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে ধিক্কার জানিয়ে মনে মনেই বলি, এ রকম একটা নিমকহারামের দেউড়ি বাংলাদেশে হলে খুব ভালো হতো।
প্রকৃতিও সায় দিল যেন আমার কথায়। ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতেই শুরু হলো প্রবল বর্ষণ!
ঢাকা, ৬ আগস্ট ২০১৫
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।