'নেই নেই'-এর শহর রংপুর

রংপুর
রংপুর

রংপুর শহর দিনের পর দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। একটি বসবাস উপযোগী শহর দিনের পর দিন পরিকল্পনাহীনতার কারণে দুর্ভোগের শহরে পরিণত হচ্ছে। রংপুর পৌরসভা ২০১০ সালে যখন বিভাগীয় শহরে উন্নীত হলো, তখন শহরবাসী ভেবেছিল এখন নাগরিক সুবিধা বাড়বে। এরপর ২০১২ সালে যখন সিটি করপোরেশন হলো, তখনো একই ভাবনা ছিল। কিন্তু নাগরিক সুবিধার পরিবর্তে সংকট বাড়তে থাকল। দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সেবার মান বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানে তার উল্টো।

রংপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাত বছরে প্রকৃত অর্থে নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির জন্য কিছুই করা হয়নি। রংপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর বেড়েছে বাসাভাড়া, বেড়েছে কর। যানজটে পথেই নষ্ট হচ্ছে অনেক সময়। আরও দুঃখজনক যে আজ পর্যন্ত এই শহরের মাস্টারপ্ল্যানই অনুমোদন হয়নি। এমনকি অর্গানোগ্রামও চূড়ান্ত হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

রংপুর শহর একসময় ছিল শান্তির শহর। এই শহরে খুন-ছিনতাই-ডাকাতি ছিল না বললেই চলে। বৃষ্টিতে শহরের কোথাও পানি জমত না। এখন জীবনের নিরাপত্তা কমছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই শহরের অনেক সড়কে পানি জমে থাকে। সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে বিভিন্ন দপ্তরের কাজের মধ্যেও রয়েছে চরম সমন্বয়হীনতা। এসব দেখে বোঝা যায় কতটা অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে এই শহর।

২০১১ সালে রংপুর শহরের রাস্তা চার লেন করার কাজ শুরু হয়। চার লেনের কাজ শুরুর আগেই সড়কের ভেতর থেকে বিদ্যুতের খুঁটি সরানো উচিত ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই বিদ্যুতের খুঁটি সরানো সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় মেয়র মোস্তাফিজার রহমানের দুই বছর হতে চলল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ফটক বরাবর সড়কের ভেতর থেকে বিদ্যুতের খুঁটি সরাতে পারেননি। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ টলটলে। এখন তো নাক বন্ধ করে শ্যামাসুন্দরী পার হতে হয়। সিটি করপোরেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দূষিত পানির অসংখ্য নালা শ্যামাসুন্দরী নদীতে ফেলছে। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একসময়ের দৃষ্টিনন্দন নদীটির সর্বনাশের জন্য সিটি করপোরেশন এবং নদীতীরবর্তী অনেক নাগরিকেরও দায় কম নয়।

সিটি করপোরেশন আজ পর্যন্ত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব বাসার ময়লা-আবর্জনা ফেলার দায়িত্ব নিতে পারেনি। শহরের মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে পারেনি। শহরের শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারেনি। সড়ক প্রস্থে অনেক হলেও প্রায় অর্ধেক সড়কজুড়ে দোকানপাট, গাড়ি পার্কিং। নাগরিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব না হলেও কর বৃদ্ধি করতে কার্পণ্য করেনি সিটি করপোরেশন। শহরের অনেক সড়কের বেহাল দশা।

নতুন এই সিটি করপোরেশনের জন্য সরকারিভাবে আলাদা বাজেট দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে কাজ করা হয়নি। রংপুর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ে সেবা দেওয়ার মতো সামর্থ্য হবে না। শহরে নতুন করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং কিছু কিছু সড়কের কাজ করে দিচ্ছে জাইকা। সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন বলতে ওইটুকুই।

চিকলি বিল দর্শনার্থীদের জন্য আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। রংপুরকে ঘিরে রয়েছে বুড়াইল, ঘাঘট, খোকসা-ঘাঘট নদ। সিটি করপোরেশন এ নদ–নদীগুলোর দুই পাশ ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে। রংপুরে ঢোকার মুখে পার্ক মোড় এলাকায় ত্রিভুজাকৃতির উঁচু স্থানটি সংস্কার করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে একটি করে মডেল কলেজ আছে। রংপুরে নেই। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে, রংপুরে তা-ও নেই। রংপুরে সাংস্কৃতিক চর্চাও কমে গেছে। মাদকের ভয়াবহতা তীব্রতর।

একসময় রাজশাহী ছিল অপরিচ্ছন্ন শহর। সিটি করপোরেশনের মেয়র, স্থানীয় সাংসদ, জেলা এবং বিভাগীয় প্রশাসন সবাই মিলে যৌথ প্রচেষ্টায় রাজশাহী সিটি করপোরেশন শহরটিকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে। পরিকল্পিতভাবে এগুলো করা হলে রংপুরও একটি আদর্শ শহরে পরিণত হতে পারে।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক
[email protected]