'বঞ্চিত' বগুড়াবাসীর দাবিনামা

উন্নতির মতোই যানজটেও থমকে থাকে বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা l ছবি: সোয়েল রানা
উন্নতির মতোই যানজটেও থমকে থাকে বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা l ছবি: সোয়েল রানা

শনিবার সকালে ম্যাক্স মোটেলে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাতেও বগুড়ার উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বগুড়াবাসীর প্রধান দাবি কী—জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বগুড়ায় একটি বিমানবন্দর স্থাপন জরুরি। দূরত্ব যত কম হোক না কেন, সড়কপথে ঢাকায় যেতে অনেক সময় লাগে। দ্বিতীয় দাবি বিশ্ববিদ্যালয়। তৃতীয় দাবি সিটি করপোরেশন ও বিভাগ।

বিভাগ নিয়ে বগুড়াবাসীর মধ্যে কিছুটা হতাশা আছে। তাঁদের কথা হলো, লোকসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে বগুড়া অনেক বিভাগীয় শহর থেকে বড়। তারপরও সিটি করপোরেশন করা হয়নি। অথচ কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার উদ্যোগ চলছে। এটিকে বগুড়ার প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ বলে মনে করেন তাঁরা। উল্লেখ্য, বর্তমানে বগুড়ার লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ, আয়তন ৭০ বর্গকিলোমিটার।

বগুড়া পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান বিএনপি–দলীয়। আগের মেয়াদেও তিনি মেয়র ছিলেন। তবে কাউন্সিলর পদে এবার আওয়ামী লীগের পাল্লাই ভারী। অনেকের অভিযোগ, বিএনপি–দলীয় মেয়র হওয়ার কারণে বগুড়া বঞ্চিত হচ্ছে। পৌরসভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, নয়টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত পৌরসভা যে বরাদ্দ পায়, বগুড়াতেও সেই বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে কীভাবে?

তবে বগুড়ার নাগরিক আন্দোলনের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি আমলে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হলেও রাজনৈতিক কারণে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আটকে দেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে যে ১২টি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বগুড়ারও একটি ছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করে দেয়। তখন বিএনপি নেতা তারেক রহমান নাকি বলেছিলেন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বগুড়ায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু গত দেড় দশকেও সেই বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি। বগুড়ার বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪০ হাজার। গত কয়েক
বছরে রাজশাহী বোর্ডের পরীক্ষায় বগুড়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ফল করে আসছে। এ কারণে এখানে শিক্ষার্থীদের ভিড়ও বেশি। কিন্তু সরকারি স্কুল মাত্র দুটি। বগুড়াবাসীর দাবি, অন্তত আরও দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করা হোক।

বগুড়া বিভাগের দাবিও বেশ পুরোনো। এ নিয়ে বগুড়াবাসী অনেক আন্দোলন-সংগ্রামও করেছেন। তঁারা চান, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ নিয়ে নতুন বিভাগ হোক। 

বগুড়াবাসীর আরেকটি প্রধান দাবি বঙ্গবন্ধু সেতুর সঙ্গে রেলযোগাযোগ স্থাপন। তাঁরা মনে করেন, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি রেলযোগাযোগ স্থাপিত হলে এখানকার শিল্প ও কৃষিপণ্য পরিবহন সহজতর হবে। যাত্রীরাও কম সময়ে, কম খরচে যাতায়াত করতে পারবেন।

২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়া সফরকালে বলেছিলেন, বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়, রেলপথ, অর্থনৈতিক জোন—সবই হবে। তিনি এও বলেছিলেন যে বিএনপি উন্নয়ন করেনি, মানুষ মেরেছে। তাঁর সরকার সারা দেশের উন্নয়ন করবে, বগুড়াও বিমুখ হবে না। বগুড়াবাসী এখন প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর নতুন রেললাইন স্থাপন নিয়ে কিছুটা তৎপরতা দেখা গেলেও দৃশ্যমান কিছু হয়নি। জমি অধিগ্রহণের কাজও এগোয়নি। তবে এই সরকারের আমলে আড়াই হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সাইলো স্থাপন করা হয়েছে। আগামী মাসে এটি উদ্বোধন হওয়ার কথা।

বিকেলে প্রথম আলো অফিসে কথা হয় সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বজলুল করিম বাহার, নাট্যকর্মী তৌফিক হাসান ময়না, আইনজীবী আবদুল লতিফ, উন্নয়নকর্মী কে জি এম ফারুক ও এম এ খালেকের সঙ্গে। উপস্থিত​ ছিলেন প্রথম আলোর বগুড়া প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজও। বগুড়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক নেতারা যখন খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত, তখন বগুড়ার সংস্কৃতিকর্মীরা জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁরা নিয়মিত নাটক-অনুষ্ঠান করছেন। সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মানববন্ধন দেখলাম। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রচুর ছেলেমেয়ে তাতে অংশ নিয়েছে।

বগুড়ার নাগরিক প্রতিনিধিরা জানালেন, এক বছর ধরে তাঁরা নবাববাড়ি উদ্ধারের আন্দোলন করছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনও সহায়তা করছে। কিন্তু আগে থেকেই একটি প্রভাবশালী মহল বাড়িটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এমনকি তারা নবাববাড়ির একজন প্রতিনিধির কাছ থেকে কথিত দলিলও করিয়ে নিয়েছে। এ কারণে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এটিকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করলেও দখ​েল নিতে পারেনি। বাড়ির সামনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ছোট্ট ফলকের পাশে কথিত ক্রেতার বিশাল ফলক ঝুলছে। এ ব্যাপারে বগুড়ার সংস্কৃতিসেবীরা সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গেও বসেছেন।

 বগুড়ার যানজটের কথা উল্লেখ করে একজন ব্যবসায়ী জানালেন, এক দশক আগে সড়কগুলো যখন প্রশস্ত করা হয়েছিল, তখন শহরে এত যানবাহন ছিল না। এখন যানবাহন বেড়েছে। ফলে সড়কগুলো আরও প্রশস্ত করা প্রয়োজন। সাতমাথা মোড়ে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। তিনি বললেন, পঞ্চগড় থেকে বগুড়া হয়ে যে সড়কটি ঢাকা গেছে, এটি চার লেন হওয়া দরকার। গত সোমবার টিভির খবরে দেখলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে পলাশবাড়ী হয়ে রংপুর পর্যন্ত চার লেন হচ্ছে। এটি কেবল বগুড়াবাসী নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলের জন্যই সুসংবাদ।

তৌফিক হাসান ময়নার মতে, বিএনপি আমলে উন্নয়নের নামে অনেক অঘটনও ঘটেছে, যার জ্বলন্ত উদাহরণ বগুড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সারা দেশে শহীদ মিনারের যে শিল্প-সৌন্দর্য ও নকশা, তার থেকে এটি ভিন্ন ও বেঢপ আকৃতির। বগুড়াবাসীর দাবি, এটি ভেঙে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হোক। থমসন হল উদ্ধার করে বগুড়ায় একটি আধুনিক মিলনায়তন স্থাপন করা হোক। তাতে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ বাড়বে।

বগুড়াবাসীর দুঃখ করতোয়া নদী। এককালের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান বাহন এই নদীটি দখল হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। আর এই দখলবাজিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই।

বগুড়ার রাজনীতি কেমন চলছে? এর জবাবে নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি জানালেন, বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়ায় বিএনপির অবস্থা ভালো নয়। আর আওয়ামী লীগ আছে দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। সংগঠন নিয়ে কেউ ভাবছেন না। তাঁর মতে, বিএনপির জেলা সভাপতি সাইফুল ইসলাম তারেক রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন। আবার তিনি আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন। দলের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। ১ সেপ্টেম্বর  বিএনপি যে সমাবেশ ও মিছিল করেছে, তাকে অনেকে ফটোসেশন বলে অভিহিত করেছেন। বিএনপির বেহাল অবস্থার জন্য মূলত হঠকারী রাজনীতিই দায়ী। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণ মিছিল থেকে পুলিশের ওপর পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হলে চার–পাঁচজন মানুষ মারা যান। অসংখ্য গাড়ি পোড়ানো হয়। এরপর বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় চলে, অনেকে কারারুদ্ধ হন। তবে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিরাপদেই ছিলেন বলে বগুড়ার সাংবাদিক বন্ধুরা জানালেন।

অভিযোগ আছে, ওয়ার্ড কমিটি, সম্মেলনে প্রতিনিধি মনোনয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে জেলা নেতাদের প্রচুর অর্থ দিতে হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বিরোধী দ​লও পিছিয়ে নেই। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা বরাবরই নাজুক। পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। অপূর্ণ কমিটির সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের একক কর্তৃত্বে দল চলে। চেম্বার থেকে ডায়াবেটিক সমিতি—সবখানে ক্ষমতাসীনদের দখলবাজি চলছে। আর পরিবহন খাত পুরোটাই শ্রমিক ও যুবলীগের নিয়ন্ত্রণে। এক হিসাবে জানা যায়, প্রতিদিন বগুড়ায় তিন হাজার বাস–ট্রাক চলে এবং প্রতিটি যানবাহন থেকে গড়ে ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সে ক্ষেত্রে বছরে চাঁদার পরিমাণটি সহজেই অনুমান করা যায়।

বগুড়ায় সাতটি আসনের মধ্যে মাত্র দুটি আওয়ামী লীগের সাংসদ—আবদুল মান্নান ও হাবিবুর রহমান। বাকি পাঁচটির একটি জাসদ ও চারটি জাতীয় পার্টির। সাংসদেরা দলের নেতা–কর্মীদের খুব একটা পাত্তা দেন না। প্রশাসনের যোগসাজশে তঁারাই সবকিছু করেন।

বগুড়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা স্বীকার করেন, বিএনপির সময় তারেক রহমানের উদ্যোগে বগুড়ার উন্নয়ন হয়েছে। আবার দলের বর্তমান দুরবস্থার জন্যও তিনি দায়ী। বিএনপি আমলে চম্পা মহল দ্বিতীয় হাওয়া ভবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা কী জানতে চাইলে একজন বললেন, স্থানীয় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। জামায়াত কাজ করে গোপনে। মিছিল, সমাবেশ নেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা করেই জামায়াত নেতাদের হাসপাতাল, কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু আছে। গত নির্বাচনে পাঁচটি উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বগুড়া শিল্পায়নে এগিয়ে আছে। বগুড়ায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০টি পাটকল, ২টি কাগজকল ও ১টি সিমেন্ট কারখানা আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে কৃষিসরঞ্জাম, শ্যালো মেশিন, ধানমাড়াই কল, টাইলস, পোলট্রি ফিড এবং ইজিবাইক কারখানা চালু রয়েছে। ২০১৫ সালে টর্নেডোতে পোলট্রি শিল্পে বিপর্যয় হলেও সেগুলো আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।