'বাংলাদেশ ফকির হয়্যা যাবে'

বিএনপির তালাবদ্ধ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশ
বিএনপির তালাবদ্ধ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশ

বেলা ১১টার রোদঝলমলে আকাশ, বাতাসে শীত নেই, চমৎকার আবহাওয়া। কিন্তু মহানগর ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা নেই, যা সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসের এই সময়টাতে থাকে। কারণ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অবরোধের মধ্যেই আজ আবার শুরু হয়েছে ৩৬ ঘণ্টার হরতাল।
বাংলামোটর থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত বাসে, সেখান থেকে রিকশায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশে প্রাণচাঞ্চল্যহীন ঢিলেঢালা পরিবেশই চোখে পড়ে। রিকশাচালককে বলছিলাম, ‘কে বলে হরতাল হয় না? হরতাল তো হচ্ছে!’ আমার কথা শুনে সে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘হরতাল হইব না ক্যান? যেভাবে মানুষ পুইড়্যা মরতাছে, সবাই ডরাইছে।’
‘নাম কী ভাই আপনার?’
‘মোস্তফা।’
‘বাড়ি?’
‘টাঙ্গাইল।’
‘মানুষ ডরাইছে, আপনার ভয়-ডর নাই?’
‘গরিবের ভয়-ডর থাকতে নাই। ডরের আগে তো প্যাট। প্যাট বাঁচাইতে কাম করতেই হইব। মরলে মরছি, কিছু করার নাই।’
বিজয়নগর শান্ত ও নীরব; রাস্তার ধারে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। বেশির ভাগ দোকানপাট খোলা, কিন্তু ক্রেতাদের ভিড় নেই, ফুটপাতেও পথচারী কম। মৎস্য ভবনের মোড়ে যেমনটি দেখেছিলাম, এখানে রাস্তার পাশে পুলিশের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তারা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে, উত্তেজনা কিংবা বাড়তি সকর্তার ভাব চোখেমুখে নেই। বরং যেন একধরনের ক্লান্তি কিংবা আলস্য গ্রাস করেছে তাদের।
কাকরাইলের মোড়ে রিকশা ডানদিকে ঘোরার মুখে কজন পুলিশ সদস্যকে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তাঁদের চোখের দৃষ্টিতে সতর্কতা: যারা ওই রাস্তা দিয়ে রিকশায়, বাসে কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মতিঝিলের দিকে যাচ্ছে, তাদের দিকে সন্ধানী চোখে তাকাচ্ছেন। নিশ্চিত হতে চাইছেন যে কেউ অস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু রিকশা ছাড়া অন্যান্য যানবাহন বিরল।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে রিকশাচালককে থামতে বলি। ৩০-৩২ বছরের যুবক রিকশাচালকটি থেমে দাঁড়ান। ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে হাসিমুখে জিগ্যেস করি, ‘ভোট দেন কী মার্কায়?’
‘ধানের শীষ। আমরা গুষ্টিসুদ্ধা বিম্পি।’
‘ধানের শীষঅলারা যে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে?’
‘এইডা খারাপ কাম করতাছে।’
‘খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেছে, জানেন?’
‘হ। মনে করছিলাম, এইবার হরতাল বাতিল করব।’
‘শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বাড়ি গেছিল সান্ত্বনা দিতে, খালেদা জিয়া দরজা খোলেনি। কেমন হলো ব্যাপারটা?’
‘না খোলার কারণ আছে।’
‘কী কারণ?’
‘দুয়ার যদি খুলত, দুই নেত্রীর যদি কতাবার্তা হইত, আর যদি মায়া-মোহব্বত লাইগ্যা যাইত, তাইলে তো অবরোধ-হরতাল আর চালাইতে পারত না।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় পুলিশের চারজন নারী ও এগারো জন পুরুষ সদস্য কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একটা প্রাচীরের মতো। তাঁদের মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হাতে লাঠি। আগ্নেয়াস্ত্রও আছে কয়েকজনের হাতে। তাঁদের ডানে ও বাঁয়ে পুলিশের বেশ কয়েকটি মোটরযান। তাঁদের পেছনে, বিএনপির কার্যালয়ের বিল্ডিংটার নিচতলায় বসে আছেন পুলিশের আরও অনেক সদস্য। কার্যালয়ে ঢোকার কলাপসিবল গেটটি বন্ধ, ভেতরের দিকে তালা ঝুলছে। গেটের ভেতরে মেঝেতে পড়ে আছে অনেক পোস্টার, ছেঁড়া কাগজ, আবর্জনা। মনে হয় বহুদিন ধরে কেউ সেখানে ঢোকেনি। গেটের ভেতরের দিকে তালা ঝুলতে দেখে পুলিশের এক সদস্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অফিসের ভেতরে কি কেউ আছে? তালা তো ভেতর থেকে লাগানো।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না, ওরা বাইরে থেকে তালা লাগায়া চলে গেছে। ভিতরে কেউ নাই।’
দেশের দুই বড় দলের একটি, যারা জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দুবার সরকার গঠন করেছিল, সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে যারা দুই মেয়াদ কাটিয়েছে, সেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কত দিন ধরে তালা ঝুলছে, কী কারণে ঝুলছে, তাদের নিচতলার একটি অংশকে পুলিশ প্রায় একটা অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়েছে কেন? এসব প্রশ্ন মনে জাগে। এক অফিসারকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, এসব বিষয়ে আমি কার সঙ্গে কথা বলতে পারি। ‘কী কথা বলবেন?’ বলে তিনি ভীষণ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দুই মাস আগেও সেখানে একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কামরুল হাসানকে টেলিফোনে বললাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন রাখা সম্পর্কে সরকারের ব্যাখ্যা কার কাছে পাওয়া যেতে পারে? তিনি জবাবে বললেন, ‘কারও কাছেই পাওয়া যাবে না। এ বিষয়ে পুলিশের কেউ কোনো কথা বলেন না।’
বিএনপি অফিসের সামনে এক রিকশায় উঠলাম। রিকশাচালককে জিগ্যেস করে জানতে পেলাম তাঁর বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি, নাম আবদুস সালাম। বগুড়ার লোক ভেবে বললাম, ‘বিএনপির সমর্থক?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আমার দুই মা, আমরা ১০ ভাই। আমি আওমিলিগ করি, আমার আপন মায়ের প্যাটের ভাই করে বিএনপি। সৎমায়ের প্যাটের এক ভাই করে আওমিলিগ। ১০ জনের মধ্যে দুজন আওমিলিগ, বাকি আটজন বিম্পি করে।’
পল্টন মোড়ে যানবাহনের ভিড়। এই দৃশ্য দেখে মনে হয় না হরতাল চলছে। মোড় পেরিয়ে রিকশা সোজা জিরো পয়েন্টের দিকে এগোতে থাকলে যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে জিরো পয়েন্ট পার হলে আবার কমে যায়। এই অঞ্চলে পায়ে চলা মানুষের সংখ্যা বেশি। কানে আসতে শুরু করে স্লোগানের শব্দ: ‘অবৈধ হরতাল জনগণ মানে না।’ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ শুরু হওয়ার আগেই, গোলাপশাহ মাজারের কাছাকাছি রাস্তার বাঁ পাশে ব্যানার-ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পুরোটাই তাঁদের দখলে। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে চলছে ‘হরতাল-নাশকতাবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ’, জোড়া মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বক্তৃতা করছেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। তিনি বলছেন আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যাওয়ার ঘটনাটির কথা, তীব্র ভাষায় সমালোচনা করছেন খালেদা জিয়ার।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশের দোকানপাট সবই খোলা, কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। দোকানিদের মুখ শুকনো।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পেরিয়ে বড় রাস্তার ফুটপাতে উঠি। সেখানে একটি তৈরি পোশাকের সামনে দাঁড়াই: প্যান্ট, জ্যাকেট ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে মলিন মুখে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক লোক। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বললেন দুলাল মিয়া।
‘বেচাকেনা কেমন?’
‘নাই।’ ঠোঁট উল্টিয়ে বললেন দুলাল মিয়া। আমি জানতে চাইলাম, বেচাকেনা যদি নাই থাকে, তাহলে দোকান খুলে বসে থাকা কেন? দুলাল মিয়া বললেন, ‘আগে দৈনিক বিক্রি ছিল চার-পাঁচ হাজার টেকা। এখন কোনো দিন হয় ১২০০, কোনো দিন কপাল খুব ভালো হইলে হাজার দুয়েক। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থিকা এই অবস্থা। যতই দিন যাইতাছে, ততই অবস্থা খারাপ হইতাছে।’ একটু থেমে দুলাল মিয়া আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনেরা তো জানেন দেশে কী হইতেছে। এই অবস্থা আর কদ্দিন চলবে, স্যার?’
বড়ই করুণ শোনাল দুলাল মিয়ার কণ্ঠ। বললাম, ‘জানি না, ভাই। অবরোধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।’
দুলাল মিয়া হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘আর কিছুদিন এইভাবে চললে স্যার, বাংলাদেশ ফকির হয়্যা যাবে। আমরা বাঁচুম না। সব গরিব মানুষ মইরা শ্যাষ হয়্যা যাবে।’
কয়েক কদম হাঁটার পর ট্রপিক্যাল ক্লিনিক নামের একটি ওষুধের দোকানে ঢুকলাম। ভাবলাম অবরোধ-হরতালে তো মানুষের ওষুধ কেনা থেমে থাকে না। দোকানটিতে কর্মরত তিন কর্মীর একজনকে জিেজ্ঞস করলাম, ‘আপনাদের বিক্রি কেমন?’
‘খুব খারাপ।’
‘কেন? হরতাল-অবরোধে মানুষের ওষুধ লাগে না নাকি?’
‘তা তো লাগে। কিন্তু মানুষের চলাফিরা কমে গেলে তো আমাদের বিক্রিবাট্টাও কমে যায়। গুলিস্তান ঢাকার প্রাণকেন্দ্র, এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন আসে। অবরোধ-হরতালের কারণে তো মানুষের চলাফিরা কমে গেছে। আগে আমাদের দৈনিক বিক্রি ছিল ২০ হাজার টাকা। এখন ১০ হাজারও হচ্ছে না। এভাবে তো চলা যায় না।’
‘সমাধান কী? সমাধানের কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমরা অবরোধ-হরতাল চাই না। ইলেকশান দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়, মানুষ যারে চায় সে গদিতে বসবে।’
‘কিন্তু সরকার কি নির্বাচন দেবে? এক বছর আগেই তো তারা নির্বাচন করেছে, বিএনপি তো তখন নির্বাচনে আসেনি। এখন আসবে কেন?’
‘তাইলে আমাদের মরণ ছাড়া কোনো গতি নাই।’
সম্ভবত এটাই এই মুহূর্তের বাস্তবতা: দুই দলের জিঘাংসাতাড়িত রাজনীতির কবলে পড়ে বাংলাদেশের জনগণের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে যাওয়া।
ঢাকা: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
[email protected]